চকের দলের ঢোল বেঁধে নিশেন তুলে, গাইতে গাইতে ঘরে চল্লেন-কারু কারু শুধু পা মোজা পায়; জুতো কোথায়, তার খোজ নাই। ওগোড়রা আমোদ কত্তে কত্তে পেছু পেছু চল্লেন-বেলা দশটা বেজে গেল; দর্শকরা হাফ-আখড়াইয়ের মজা ত্বপূর লুটে বাড়ীতে এসে সুত, ঠাণ্ডাই, জোলাপ ও ডাক্তারের যোগাড় দেখতে লাগলেন। ভাড়া করা ও চেয়ে নেওয়া চায়নাকোট, ধুতি, চাদর, জামা ও জুতোর কাজ সেরে, আপনার আপনার মনিববাড়ী ফিরে গেল।
আজ রবিবার। বারোইয়াবিতলায় পাঁচালী ও যাত্রা। রাত্রি দশটার পর অধ্যক্ষেরা এসে জমলেন; এখনো অনেকের ‘চোঁয়া ঢেকুর’ ‘মাথা-ধরা’, ‘গা মাটি মাটি’ সারে নি। পাঁচালী আরম্ভ হয়েচে-প্রথম দল গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দ্বিতীয় দল মহীরাবণের পালা ধরেচেন, পাঁচালী ছোট কেতার হাফ-আখড়াই, কেবল ছড়া কাটানো বেশীর ভাগ; সুতরাং রাত্রি একটার মধ্যে পাঁচালী শেষ হয়ে গেল।
যাত্রা। যাত্রার অধিকারীর বয়স ৭৬ বৎসর, বাবরিকাটা চুল, কপালে উল্কী, কাণে মাকড়ি! অধিকারী দূতী সেজে, গুটিবারো বুড়ো বুড়ো ছেলেকে সখী সাজিয়ে আসোরে নাবলেন। প্রথমে কৃষ্ণ খোলের সঙ্গে নাচলেন, তারপর বাসুদেব ও মণিগোঁসাই গান করে গেলেন। সকেষ্ট সখী ও দূতী প্রাণপণে ভোর পর্যন্ত ‘কালো জল খাবো না!’ ‘কালো মেঘ দেখবো না!’ (জামিয়ানা খাটিয়ে দিমু) কালো কাপড় পরবো না!’ ইত্যাদি কথাবার্ত্তায় ও নবীন বিদেশিনীর। গানে লোকেন্দ্র মনোরঞ্জন কল্লেন! থাল, গাড়ু, বড়, ছেঁড়া কাপড়, পুরাণ ___ ও পচা শালের গাদী হয়ে গেল। টাকা, আধুলী, সিকি ও পয়সা পর্যন্ত প্যালা পেলেন! মধ্যে মধ্যে ‘বাবা দে আমার বিয়ে’ ও ‘আমার নাম সুন্দরে জেলে, ধরি মাছ, বাউতি জালে,’ প্রভৃতি রকমওয়ারি সঙের রকমওয়ারি গানেরও অভাব ছিল না। বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙলো, একজন বাবু, মাতাল, পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন, যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন, (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী-মূর্ত্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতীকে কামড়াচ্ছে দেখে, বাবু মহাত্মার বড় রাগ হলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে–
তারিণী গো মা কেন হাতীর উপর এত আড়ি।
মানুষ মেলে টেটা পেতে তোমায় বেতে হতো হরিণবাড়ী।।
সুর্কি কুটে সারা হতো, তোমার মুকুট যেত গড়াগড়ি।।
পুলিসের বিচারে শেষে সঁপতো তোমায় গ্ৰানযুড়ি।
সিঙ্গি মামা টেরটা পেতেন ছুটতে হতে উকীলবাড়ী।।
গান গেয়ে, প্রণাম করে চলে গেলেন।
সহরের ইতর মাতালদের (মাতালদের বড় ইতর-বিশেষ নাই, মাতাল হলে কি রাজা বাহাদুর, কি পালার বাপ, কি গোবরা প্রায় এক মূর্ত্তিই ধরে থাকেন। ঘরে ধরে রাখার লোক নাই বলেই আমরা নর্দমায়, রাস্তায়, খানায়, গারদে ও মদের দোকানে মাতলামি কত্তে দেখতে পাই। সহরে বড়মানুষ মাতালও কম নাই, শুদ্ধ ঘরে ধরে পুরে রাখবার লোক আছে বলেই তারা বেরিয়ে এখন মাতলামি কত্তে পান না। এদের মধ্যে অনেকে এমন মাতলামি করে থাকেন যে, অন্তরীক্ষ থেকে দেখলে পেটের ভিতর হাত-পা সেঁধিয়ে যায় ও বাঙ্গালী বড়মানুষদের উপর বিজাতীয় ঘৃণা উপস্থিত হয়। ছোটলোক মাতালের ভাগ্যে–চারি আনা জরিমানা–এক রাত্রি গারদে থাকা বা পাহারাওয়ালাদের ঝোলায় শোয়ার হয়ে যাওয়া ও জমাদারের দুই-এক কোঁৎকামাত্র। কিন্তু বাঙ্গালী বড়মানুষ মাতালদের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা। পাখী হয়ে উড়তে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরা–বাবার প্রতিষ্ঠিত পুকুরে ডোবা, প্রতিমের নকল সিঙ্গি ভেঙ্গে ফেলে আসল সিঙ্গি হয়ে বসা, ঢাকীকে মার সঙ্গে বিসর্জ্জন দেওয়া, ক্যাণ্টনমেণ্ট, ফোর্ট, রেলওয়ে ষ্টেসন ও অবশেষে মদ খেয়ে মাতলামি করে চালান হওয়া, এ সব ত আছে। এ সওয়ায়, করুণা গান, বকসিস ও বক্তৃতার বেহদ্দ ব্যাপার।
একবার সহরের শ্যামবাজার অঞ্চলের এক বনেদী বড়মানুষের বাড়ীতে বিদ্যসুন্দর যাত্রা হচ্চে। বাড়ীর মেজোবাবু পাঁচো ইয়ার নিয়ে শুনতে বসেচেন; সামনে মালিনী ও বিদ্যে “মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ, কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী” গান করে মুঠো মুঠো প্যালা পাচ্ছে-বছর ষোল বয়সের দু’টো (ষ্টেডব্রেড) ছোকরা সখী সেজে ঘুরে ঘুরে খেমটা নাচ্চে। মজলিলে রূপের গেলাসে ব্রাণ্ডি চলচে-বাড়ীর টিকটিকি ও শালগ্রাম ঠাকুর পর্যন্ত নেশীয় চুরচুরে ও ভোঁ! যাত্রায় কমে মিলনের মন্ত্রণা, বিদ্যার গর্ভ, রাণীর তিরস্কার, চোর ধরা ও মালিনী যন্ত্রণার পালা এসে পড়লে; কোটাল মালিনীকে বেঁধে মাতে আরম্ভ কল্লে। মালিনী বাবুদের দোহাই দিয়ে কেঁদে বাড়ী সরগরম করে তুল্লে। বাবুর চমক ভেঙ্গে গেল; দেখলেন, কোটাল মালিনীকে মাচ্চে, মালিনী বাবুর দোহাই দিচ্চে; অথচ পার পাচ্ছে না। এতে বাবু বড় রাগত হলেন, “কোন্ বেটার সাধ্যি মালিনীকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়,” এই বলে সামনের রূপের গেলাসটি কোটালের রগ তেগে ছুড়ে মাল্লেল; গেলাসটি কোটালের রগে লাগবামাত্র কোটাল ‘বাপ!’ বলে, অমনি ঘুরে পড়লো চারিদিক থেকে লোকেরা হাঁ হাঁ করে এসে কোটালকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। মুখে জলের ছিটে মারা হলো ও অন্য অন্য নানা তদ্বির হলো : কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না—কোটালের-পো এক ঘাতেই পঞ্চত্ব পেলেন।
আর একবার ঠনঠনের ‘র’ ঘোষজাবাবুর বাড়ীতে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা হচ্ছিল, বাবু মদ খেয়ে পেকে মজলিসে আড় হয়ে শুয়ে নাক ডাকিয়ে যাত্রা শুনছিলেন। সমস্ত বাত বেহু সেই কেটে গেল, শেষে ভোর ভোর সময়ে দক্ষিণ-মশানে কোটালের হাঙ্গামাতে বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হলো; কিন্তু আসোরে কেষ্টোকে না দেখে বাবু বিরক্ত হয়ে “কেষ্ট ল্যাও, কেষ্ট ল্যাও’ বলে ক্ষেপে উঠলেন। অন্য অন্য লোকে অনেক বুঝালেন যে, “ধৰ্ম্ম অবতার। বিদ্যাসুন্দর যাত্রায় কেষ্ট নাই;” কিন্তু বাবু কিছুতেই বুঝলেন না; (কৃষ্ণ তাঁরে–নিতান্ত নির্দয় হয়ে দেখা দিলেন না বিবেচনায়) শেষে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলেন।