ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এলো–বারোইয়ারিলা লোকারণ্য; সহরের অনেক বাবু গাড়ী চড়ে সং দেখতে এসেছেন—স’ এলে অনেকে তাঁদের দেখচে। ক্রমে মজলিসে দু-একটা ঝাড় জ্বেলে দেওয়া হলো। সঙদের মাথার উপর বেললণ্ঠন বাহার দিতে লাগলো। অধ্যক্ষবাবুরা একে একে জমায়েৎ হতে লাগলেন। নল-করা থেলো হুঁকো হাতে করে ও পান চিবুতে চিবুতে অনেকে চীৎকার ও ‘এটা কর ওটা কর’ ক’রে হুকুম দিচ্চেন। আজ ধোপাপাড়ার ও চকের দলের লড়াই হবে। দেড় মণ গাঁজা, দুই মণ চরস, বড় বড় সাত গামলা দুধ ও বারোখানি বেণের দোকান ঝেঁটিয়ে ছোট বড় মাঝারি এলাচ, কর্পূর দারুচিনি সংগ্রহ করা হয়েছে; মিঠেকড়া ভ্যালসা অম্বুরি ও ইরানি তামাকের গোবর্দ্ধন হয়েচে। এ সওয়ায় বিস্তর অন্তঃশিলে সরঞ্জামও প্রস্তুত আছে;আবশ্যক হলে দেখা দেবে।
সহরে ঢি ঢি হয়ে গেছে, আজ রাত্রে অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পূজোর হাফ-আখড়াই হবে। কি ইয়ারগোচের স্কুল বয়, কি বাহাত্তুরে ‘ইনভেলিড’ সকলেই হাফ-আখড়াই শুনতে পাগল। বাজার গরম হয়ে উঠলো। ধোপারা বিলক্ষণ রোজগার কত্তে লাগলো। কোচান-ধুতি, ধোপদস্ত কামিজ ও ডুরে শান্তিপুরে উড়ুনীর এক রাত্রের ভাড়া আট আনা চড়ে উঠলো। চার পুরুষে পাঁচ পুরুষে ক্রেপ ও নেটের চাদরেরা, অকর্ম্মণ্য হয়ে নবাবী আমলে সিন্দুক আশ্রয় করেছিলেন, আজ ভলন্টিয়র হয়ে মাথায় উঠলেন। কালো ফিতের ঘুন্সি ও চাবির শিকলি, হঠাৎ বাবুর মত স্বস্থান পরিত্যাগ করে ঘড়ির চেনের অফিসিয়েটিং হলো–জুতোরা বেশ্যার মত নানা লোকের সেবা কত্তে লাগলো।
বারোইয়ারিতলায় লোকারণ্য হয়ে উঠলো, একদিকে কাঠগড়া ঘেরা মাটির সং–অন্যদিকে নানা রকম পোষাক-পরা কাঠগড়ার ধারে ও মধ্যে জ্যান্ত সং। বড়মানুষের ট্যাসলওয়ালা টুপী চাপকান, পেটি ও ইষ্টিকে চালচিত্রের অসুর হতেও বেয়াড়া দেখাচ্ছেন। প্রধান অধ্যক্ষ বীরকৃষ্ণবাবু লক্কাই লাট্টুর লাটিম মত ঘুরে বেড়াচ্চেন, দু’কস দিয়ে পাজির ছবির রক্তদন্তী রাক্ষসীর মত পানের পিক গড়িয়ে পড়ছে। চাকর, হরকরা, সরকার, কেরাণী ও ম্যানেজারদের নিশ্বেস এ্যালবার অবকাশ নাই।
ঢং ঢং ক’রে গির্জ্জের ঘড়ীতে রাত্রি দুটো বেজে গেল। ধোপাপাড়ার দল ভরপুর নেশায় ভোঁ হয়ে টলতে টলতে আসরে নাবলেন। অন্সেকে আখড়াঘরে (সাজঘরে শুয়ে পড়লেন। বাঙ্গালীর স্বভাবই এই, পরের জিনিস পাতে পড়লে শীগগির হাত বন্ধ হয় না; (পেট সেটি বোঝে না, বড় দুখের বিষয়!) দেড়ঘণ্টা ঢোল, বেহালা, ফুলোট, মোচাং ও সেতারের রং ও সাজ বাজলো, গোড়ার দু’শ বাহবা ও দু-হাজার বেশ দিলেন, শেষে একটি ঠাকরুণ বিষয় গেয়ে, (আমরা গানটি বুঝতে অনেক চেষ্টা কল্লেম, কিন্তু কোনমতে কৃতকার্য্য হতে পাল্লেম না) ধোপাপাড়ার দল উঠে গেল, চকের দল আসরে নাবলেন।
চকের দলেরাও ঐ রকম করে গেয়ে শোভান্তরী, সাবাস ও বাহবা নিয়ে উঠে গেলেন—একঘণ্টার জন্য মজলিস খালি রইলো; চায়নাকোট, ক্রেপের, নেটের ও ডুরে ফুলদার ট্যারচা চাদরো পিঁপড়ের ভাঙ্গা সারের মত ছড়িয়ে পড়লেন। পানের দোকান শূন্য হয়ে গেল। চুরোট তামাক ও চরসের ধুয়ায় এমনি অন্ধকার হয়ে উঠলো যে, সেবাবে “প্রোক্লেমেশনের” উপলক্ষে বাজিতে বা কি ধোঁ হয়েছিল। বড় বড় রিভিউয়ের তোপে তত ধোঁ জন্মে না। আধঘণ্টা প্রতিমেখানি দেখা যায় নি ও পরস্পর চিনে নিতেও কষ্ট বোধ হয়েছিল।
ক্রমে হঠাৎ-বাবুর টাকার মত, বসন্তের কুয়াসার মত ও শরতেব মেঘের মত, ধোঁ দেখতে দেখতে পরিষ্কার হয়ে গেল। দর্শকেরা স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, ধোপাপুকুরের দল আসোর নিয়ে বিরহ ধোল্লেন। আধঘণ্টা বিরহ গেয়ে আসোর হতে দলবল সমেত আবার উঠে গেলেন। চকবাজারেরা নাবলেন ও ধোপাপুকুরের দলের বিরহের উতোর দিলেন। গোঁড়ারা রিভিউয়ের সোজারদের মত দুল বেঁধে দু’ থাক হলো। মধ্যস্থেরা গানের চোতা হাতে করে বিবেচনা কত্তে আরম্ভ করেন–একদলে মিত্তির খুঁড়ো, আর একদলে দাদাঠাকুর বাঁধন্দার।।
বিরহের পর চাপা কাঁচা খেউড়; তাতেই হার-জিতের বন্দোবস্ত, বিচারও শেষ; (মধুরেণ সমাপয়েৎ) মারামারিও বাকি থাকবে না।
ভোরের তোপ পড়ে গিয়েছে, পূর্ব্বদিক্ ফরসা হয়েচে, ফুরফুরে হাওয়া উঠেচে-ধোপাপুকুরের দলেরা আসোর নিয়ে খেউড় ধলেন, “সাবাস! ‘বাহবা!’ ‘শোভান্তরী।’ ‘জিতা রও!’ দিতে দিতে গোড়াদের গলা চিরে গেল; এই তামাসা দেখতে যেন সূর্য্যদেব তাড়াতাড়ি উদয় হলেন। বাঙ্গালীরা আজো এমন কুৎসিত আমোদে মত্ত হন ব’লেই যেন—চাঁদ ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে লজ্জিত হলেন। কুমুদিনী মাথা হেঁট কল্লেন! পাখীরা ছি ছি ক’রে চেঁচিয়ে উঠলো! পদ্মিনী পাঁকের মধ্যে থেকে হাসতে লাগলো! ধোপাপুকুরের দল আসের নিয়ে খেউড় গাইলেন; সুতরাং চকের দলকে তার উতোর দিতে হবে। ধোপাপুকুরওয়ালার দেড়ঘণ্টা প্রাণপণে চেঁচিয়ে খেউড়টি গেয়ে থামলে, চকের দলেরা নাবলেন; সাজ বাজতে লাগলো। ওদিকে আখড়াঘরে খেউডের উতোর প্রস্তুত হতে লাগলো;–চকের দলেরা তেজের সহিত উতোর গাইলেন। গোঁড়ারা গবুম হয়ে “আমাদের জিত, আমাদের জিত।” করে চেঁচাচেঁচি কত্তে লাগলেন; (হাতাহাতি ও বাকি রইলো না) এদিকে মধ্যস্থেরাও চকের দলের জিত সাব্যস্ত কল্লেন। দুও! হো! হো! হুর্রে ও হাততালিতে ধোপাপুকুরের দলেরা মাটির চেয়ে অধম হয়ে গেলেন—নেশার খোয়ারি-রাত জাগবার ক্লেশ ও হারের লজ্জায় মুখুয্যেদের ছোটবাবু ও দু-চার ধরুতা দোহার একেবারে এলিয়ে পড়লেন।