কোথাও ভীষ্ম শরশয্যায় পড়েচেল—অর্জ্জুন পাতালে বাণ মেরে ‘ভোগবতী’র জল তুলে খাওয়াচ্চেন। জ্ঞাতির পরাক্রম দেখে, দুর্য্যোধন ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে রয়েচেন। সঙদের মুখে ছাঁচ ও পোষাক সকলেরই এরকম, কেবল ভীষ্ম দুধের মত সাদা, অর্জ্জুন ডেমাটিনের মত কালো ও দুৰ্য্যোধন গ্রীণ।
কোথাও নবরত্নের সভা–বিক্রমাদিত্য বত্রিশ পুতুলের সিংহাসনের উপর আফিমের দালালের মত পোষাক পরে বসে আছেন। কালিদাস, ঘটকর্পর, ঝরাহমিহির প্রভৃতি নবরত্নেরা চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন—রত্নদের সকলেরই একরকম ধুতি, চাদর ও টিকি; হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, যেন একদল অগ্রদানী ক্রিয়াবাড়ী চোকবার জন্য দরোওয়ানের উপাসনা কচ্চে।
কোথাও শ্ৰীমন্ত দক্ষিণ মশানে চৌত্রিশ অক্ষরে ভগবতার স্তব কচ্চেন, কোথাও কোটালেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েচে–শ্ৰীমন্তের শাখার শালের শামলা, হাক ইংরাজী গোছের চাপকান ও পায়জামা পরা; ঠিক যেন একজন হাইকোর্টের প্লীডার প্লীড কচ্চেন! এক জায়গায় রাজসূয় যজ্ঞ হচ্ছে—দেশ দেশান্তরের রাজারা চারিদিকে ঘিরে বসেচেন—মধ্যে ট্যানা-পরা হোতা পোতা বামুনরা অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে বসে হোম কচ্চেন। রাজাদের পোষাক ও চেহারা দেখলে হঠাং বোধ হয়, যেন একদল দরোওয়ান স্যাকরার দোকানে পাহারা দিচ্চে।
কোনখানে রাম রাজা হয়েচেন;–বিভীষণ, জাম্বুবান, হনুমান ও সুগ্রীব প্রভৃতি বানরেরা, সহুরে মুচ্ছুদ্দি বাবুদের মত পোষাক পরে চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। লক্ষ্মণ ছাতা ধরেছেন—শত্রুঘ্ন ও ভরত চামর ব্যাঞ্জন কচ্চেন, রামের বাঁদিকে সীতা দেবী; সীতের ট্যার্চ্চা শাড়ী, ঝাঁপটা ও ফিরিঙ্গি খোঁপায় বেহদ্দ বাহার বেরিয়েছে।
“বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন” সং বড় চমৎকার—বাবুর ট্যাসেল দেওয়া টুপী, পাইনাপোলের চাপকান, পেটি ও সিল্কের রুমাল, গলায় চুলের গার্ডচেন; অথচ থাকবার ঘর নাই, মাসীর বাড়ী অন্ন লুটেন, ঠাকু্রবাড়ী শোন, আর সেনেদের বাড়ী বসবার আড্ডা। পেট ভরে জলখাবার পয়সা নাই, অথচ দেশের রিফরমেশনের জন্য রাত্রে ঘুম হয় না (মশারির অভাবও ঘুম না হবার একটি প্রধান কারণ)। পুলিস, বড় আদালত, টালার নীলেম, ছোট আদালতে দিনের ব্যালা ঘুরে বেড়ান; সন্ধ্যে-ব্যালা ব্রাহ্মসভায়, মিটিং ও ক্লাবে হাঁপ ছাড়েন, গোয়েন্দাগিরি, দালালী, খোসামুদী ও ঠিকে-রাইটরী করে যা পান, ট্যাসল-ওয়ালা টুপী ও পাইনাপোলের চাপকান রিপু কত্তে ও জুতো বুরুসে সব ফুরিয়ে যায়! সুতরাং মিনি মাইনের স্কুলমাষ্টারীও কখন কখন স্বীকার কত্তে হয়।
কোথাও “অসৈরণ সৈতে নারি শিকেয় বসে কুলে মরি” সং;—“অসৈরণ সইতে নারি” মহাশয়, ইয়ং বাঙ্গালীদের টেবিলে খাওয়া, পেণ্টুলেন ও (ভয়ানক গরমিতেও) বনাতের বিলিতী কোট-চাপকনি পরা, (বিলক্ষণ দেখতে পান অথচ) নাকে চসমা, রাত্তিরে থানায় পড়ে ছুঁচো ধরে থান, দিনের বেলা রিফরমেশনের স্পিচ করেন দেখে–শিকেয় ঝুলচেন।
এ সওয়ায় বারোইয়ারিতলায় “ভাল কত্তে পারবো না মন্দ করবো, কি দিবি তা দে,” “বুক ফেটে দরজা,” “ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে,” “কাণা পুতের নাম পদ্মলোচন,” “মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়,” “হাড়-হাবাতে মিছরির ছুরি” প্রভৃতি নানাবিধ সং হয়েছে; সে সব আর এখানে উত্থাপন করার অবশ্যক নাই। কিন্তু প্রতিমের দু-পাশে “বকা ধার্ম্মিক” ও “ক্ষুদে নবাবের” সং বড় চমৎকার হয়েছে; বকা ধার্ম্মিকের শরীরটি মুচির কুকুরের মত নুদুর নাদুর–ভুঁড়িটি বিলাতী কুমড়োর মত–মাথা কামান চৈতন ফক্কা ঝুঁটি করে বাঁধা। গলায় মালা ও ঢাকের মত গুটিকতক সোণার মাদুলী—হাতে ইষ্টিকবচ–চুলে ও গোঁফে কলপ দেওয়া–কালাপেড়ে ধুতি, রামজামা ও জরির বাঁকাতাজ; গত বৎসর আশী পেরিয়েছেন–অঙ্গ ত্রিভঙ্গ! কিন্তু প্রাণ হামাগুড়ি দিচ্চে। গেরস্ত-গোচের ভদ্রলোকের মেয়েছেলের পানে আড়চক্ষে চাচ্ছেন—হরিনামের মালার ঝুলিটি ঘুরচ্চেন! ঝুলির ভিতর থেকে গুটিকতক টাকা বেমালূম আওয়াজে লোভ দেখাচ্চে!
ক্ষুদ্র নবাব,–ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে—দুধে আলতার মত রং–আলবার্ট ফেশানে চুল ফেরানো–চীনের শূয়ারের মত শরীরটি ঘাড়ে-গর্দ্দানে হাতে, লাল রুমাল ও পিচের ইষ্টিক–সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা–হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজরাজড়ার পৌত্তর; কিছু পরিচয়ে বেরোবে “হৃদে জোলার নাতি!”
বারেইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু–ঘোড়ায় চড়া হাইল্যাণ্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফুল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মুৰ্ত্তি–সিঙ্গি গায় রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মকমল দিয়ে মোড়া। ঠাকুরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আসল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে যোড়হাত করে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেপু বাজাচ্চে হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে খোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ফ্রেষ্ট!
আজ বাবোইয়ারির প্রথম পূজো, শনিবার—বীরকৃষ্ণ দাঁ, কানাই দত্ত প্যালানাথবাবু ও বীরকৃষ্ণবাবুর ফ্রেণ্ড আহিরীটোলার রাধামাধববাবুরো বেলা তিনটে পর্যন্ত বাবোইয়ারিতলায় হামরাও হয়েছিলেন;–তিনটে বড় বড় অর্ণা মোষ, একশ ভেড়া ও তিন-শ পাটা বলিদান করা হয়েছে; মুল নৈবিদ্যির আগা তোলা মোণ্ডাটি ওজনে দেড়মণ। সহরের রাজা, সিঙ্গি, ঘোষ, দে, মিত্র ও দত্ত প্রভৃতি বড় বড় দলস্থ ফোঁটা-চেলির জোড়, টিকি ও তিলকধারী উর্দ্দীপরা ও তকমাওয়ালা যত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বিদেয় হয়েছে;–‘সুপারীস’, ‘আনাহূতো’, ‘বেদলে’ ও ‘ফলারেরা’ নিমতলার শকুনির মত টেঁকে বসে আছেন। কাঙ্গালী, রেয়ো, অগ্রদানী, ভাট ও ফকির বিস্তর জমেছিল; পাহারওয়ালারাই তাদের বিদেয় দেন, অনেক গরীব গ্রেপ্তার হয়।