সময় কারুরই হাত-ধর নয়–নদীর স্রোত্রে মত, বেশ্যার যৌবনের মত ও জীবের পরমায়ুর মত, কারুরই অপেক্ষা করে না! গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে দশটা বেজে গেল, সোঁ সোঁ করে একটা বড় ঝড় উঠলো, রাস্তার ধূলো উড়ে যেন অন্ধকার অরো বাড়িয়ে দিলে–মেঘের কড়মড় কড়মড় ডাক ও বিদ্যুতের চমকানিতে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা মার কোলে কুণ্ডুলী পাকাতে আরম্ভ কল্লে–মুষলের ধারে ভারী একপসলা বৃষ্টি এলো।
এদিকে দুয়ের নম্বরের বাড়ীতে অনেকে এসে জমতে লাগলেন। অনেকে সকলের অনুরোধে ভিজে ঢ্যাপঢ্যাপে হয়ে এলেন। চারডেলে দেয়ালগিরিতে বাতি জ্বলচে—মজলিস জক জক কচ্চে–পান, কলাপাতের এঁটো নল ও থেলো হুঁকোর কুরুক্ষেত্তর! মুখুয্যেদের ছোটবাবু লোকের খাতির কচ্চেন––‘ওরে’ ‘ওরে’ ক’রে তার গলা চিরে গ্যাচে। তেলী, ঢাকাই কামার ও চাষাধোপা দোহারেরা একপেট ফির্নি মেটো, ঘণ্টো ও আটা-নেবড়ান-লুসে, ফরসা ধুতি-চাদরে ফিট হয়ে বসে আছেন, অনেকের চক্ষু বুজে এসেচে–বাতির আলো জোনাকী-পোকার মত দেখছেন ও এক একবার ঝিমকিনি ভাঙলে মনে কচ্চেন, যেন উড়চি। ঘরটি লোকারণ্য—সকলেই খাতায় খাতায় ঘিরে বসে আছেন—থেকে থেকে ফুক্কুড়ি টপ্পাটা চলচে,—অনেক সেয়ানা ফরমেসে জুতো-জোড়াটি হয় পকেটে, নয় পার নীচে রেখে চেপে বসেচেন;–জুতো এমনি জিনিস যে, দোহারদলের পরস্পরেও বিশ্বাস নাই! চকবাজারের প্যালানাথবাবুর অপেক্ষাতেই গাওনা বন্ধ রয়েছে, তিনি এলেই গাওনা আরম্ভ হবে। দু-একজন ধরতা দোহার প্যালানাথবাবুর আসবার অপেক্ষায় থাকতে বেজার হচ্চেন–দু-একজন “তাই ত” বলে দাদার বোলে বোল দিচ্চে; কিন্তু প্যালানাথবাবু বারোইয়ারির একজন প্রধান ম্যানেজার, সৌখীন ও খোসপোষাকীর হদ্দ ও ইয়ারের প্রাণ! সুতরাং তার অপেক্ষা না কল্লে তাঁর অপমান করা হয়, ঝড়ই হোক, বজ্রাঘাতই হোক আর পৃথিবী কেন রসাতলে যাক না, তাঁর এসব বিষয়ে এমন সখ যে, তিনি অবশ্যই আসবেন।
ধতা দোহার গোবিন্দবাবু বিরক্ত হয়ে নাকিসুরে ‘মনালে বঁদিয়া’ জিক্কুর টপ্পা ধরেছেন;–গাঁজার হুঁকো একবার এ থাকের পাশ মেরে ও থাকে গেল। ঘরের এককোণে হুঁকো থেকে আগুন পড়ে যাওয়ায়, সে দিকের থাকেরা রল্লা করে উঠে দাঁড়িয়ে কোঁচা ও কাপড় ঝাড়চেন ও কেমন করে আগুন পড়লো, প্রত্যেকে তারই পঞ্চাশ রকম ডিপোজিশন দিচ্চেন;—এমন সময় একখান গাড়ী গড় গড় করে এসে দরজায় লাগলো। মুখুয্যেদের ছোটবাবু মজলিস থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বারাণ্ডায় গিয়ে “প্যালানাথবাবু! প্যালানাথবাবু এলেন” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন;–দোহারদলে হুররে ও রৈ-রৈ পড়ে গেল,–ঢোলে রং বেজে উঠলো। প্যালানাথবাবু উপরে এলেন–শেকহ্যাণ্ড, গুড ইভনীং ও নমস্কারের ভিড় ঢুকতে আধঘণ্টা লাগলো।
চকবাজারের বাবু প্যালানাথ একহারা বেঁটেখেঁটে মানুষ, গত বৎসর পঞ্চাশ পেরিয়েচেন; বাবু বড় হিন্দু–একাদশী-হরিবাসর ও রাধাষ্টমীতে উপোস, উত্থানও নির্জলা করে থাকেন; বাবুর মেজাজ গরিব। সৌখীনের রাজা! ১২১৯ সালে সারবর্ন সাহেবের নিকট তিনমাস মাত্র ইংরেজী লেখাপড়া শিখে ছিলেন, সেই সম্বলেই এতদিন চলচে–সর্ব্বদা পোষাক ও টুপী পরে থাকেন; (টুপীটি এমনি হেলিয়ে হেলিয়ে পরা হয়ে থাকে যে, বাবুর ডান কাণ আছে কি না হঠাৎ সন্দেহ উপস্থিত হয়); লক্ষ্ণৌ ফ্যাশানে (বাইজীর ভেডুয়ার মত) চুড়িদার পায়জামা, রামজামা, কোমরে দোপাটা ও মাথায় বাঁকা টুপী, তাঁর মনোমত পোষাক। বাঈ ও খেমটা মহলে প্যালানাথবাবুর বড় মান! তাদের কোন দায়-দখল পড়লে বাবু আড় হয়ে পড়ে আফোতে তামায করেন, বাঈয়ের অনুরোধে হিন্দুয়ানী মাথায় রেখে কাছা খুলে ফয়তা দেন ও বাবোইয়ারির নামে তযবি পড়েন। মোসলমান-মহলেও বাবুর বিলক্ষণ প্রতিপত্তি! অনেক লক্ষ্ণৌয়ে পাতি ও ইরাণী চাপদাড়ি বাবুর বুজরুকি ও কেরামতের অনিয়ম এনসাফ করে থাকেন! ইংরেজী কেতা বাবুর ভাল লাগে না; মনে করেন, ইংরেজী লেখাপড়া শেখা শুদ্ধ কাজ চালাবার জন্য। মোসলমান-সহবাসে প্রায় দিবারাত্রি থেকে থেকে ঐ কেতাই এঁর বড় পছন্দ! সর্ব্বদাই নবাবী আমলের জাঁকজমক, নবাবী আমীরী ও নবাবী মেজাজের কথা নিয়ে নাড়াচাড়া হয়।
এদিকে দোহারের নতুন সুরের গান ধল্লেন। ধোপাপুকুর রন্ রন্ কত্তে লাগলো; ঘুমন্ত ছেলেরা মার কোলে চমকে উঠলো কুকুরগুলো খেউ খেউ করে উঠলো;–বোধ হতে লাগলো যেন, হাড়ীরে গোটাকতক শূয়ার ঠেঙ্গিয়ে মাচ্চে! গাওনার নতুন সুর শুনে সকলেই বড় খুসী হয়ে ‘সাবাস! বাহবা!’ ও শোভান্তরীর বৃষ্টি কত্তে লাগলেন–দোহারের উৎসাহ পেয়ে দ্বিগুণ চেঁচাতে লাগলো,– সমস্ত দিন পরিশ্রম করে ধোপারা অঘোরে ঘুমুচ্ছিলো, গাওনার বেতরো আওয়াজে চমকে উঠে খোটা ও দড়ি নিয়ে দৌডুলো! রাত্রি দুটো পর্যন্ত গাওনা হয়ে, শেষে সে রাত্রের মত বেদব্যাস বিশ্রাম পেলেন–দোহার, সৌখীন বাবু অধ্যক্ষের অন্ধকারে অতিকষ্টে বাড়ী গিয়ে বিছানার আড় হলেন!
এদিকে বারোইয়ারিতলায় সং গড়া শেষ হয়েচে। একমাস মহাভারতের কথা হচ্ছিলো, কাল তাও শেষ হবে; কথক বেদীর উপর ব’সে বৃষোৎসর্গের ষাঁড়ের মত ও বলিদানের মহিষের মত মাথায় ফুলের মালা জড়িয়ে রসিকতার একশেষ কচ্চেন, মূল পুঁথির পানে চাওয়া মাত্র হচ্চে, বস্তুতঃ যা বলছেন, সকলি কাশীরাম খুড়োর উচ্ছিষ্ট ও কোনটা বা স্বপাক। কথকতা পেশাটা ভাল–দিব্য জলখাবার, দিব্য হাতপাখার বাতাস; কেবল মধ্যে মধ্যে কোন কোন স্থলে আহার বিহারের আনুষঙ্গিক প্রহারটা সইতে হয়, সেইটেই মহান কষ্ট। পূৰ্ব্বে গদাধর শিরোমণি, রামধন তর্কবাগীশ, হলধর, পঞ্চানন প্রভৃতি প্রধান প্রধান কথক ছিলেন; শ্রীধর অল্পবয়সে বিলক্ষণ খ্যাত হন। বর্তমান দলে শাস্ত্রজ্ঞানের অপেক্ষা করেন না, গলাটা সাধা; চাণক্যশ্লোকের দু-আখর পাঠ ও কীর্তন-অঙ্গের দু’টো পদাবলী মুখস্থ করেই, মজুর কত্তে বেরোল ও বেদীতে বসে ব্যাস বধ করেন! কথা শোবার ও সং দেখবার জন্যে লোকের অম্ভব ভিড় হয়েছে–কুমোর, ভাওয়াল ও অধ্যক্ষেরা থেলো হুঁকোয় তামাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্চেন ও মিছে মিছে চেঁচিয়ে গলা ভাঙচেন! বাজে লোকের মধ্যে দু-একজন, আপনার আপনার কর্তৃত্ব দেখাবার জন্য, “তফাৎ তফাৎ কচ্চে, অনেকে গোছালো-গোছের মেয়েমানুষ দেখে, সঙের তরজমা করে বোঝাচ্চেন! সংগুলি বর্ধমানের রাজার বাঙ্গালা; মহাভারতের মত; বুঝিয়ে না দিলে মৰ্ম্ম গ্রহণ করা ভার!