এখন আর সে কাল নাই; বাঙ্গালী বউমানুষদের মধ্যে অনেক সভ্য হয়েচেন। গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা, মুক্তাভস্মের চূণ দিয়ে পান খাওয়া, এখন আর শোনা যায় না। কুকুরের বিয়েয় লাখ টাকা খরচ, যাত্রায় নোট প্যালা, তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ী চড়ে ভেপু বাজিয়ে স্নান কত্তে যাওয়া, সহরে অতি কম হয়ে পড়েছে। আজ্ঞা হুজুর, উঁচু গদী, কার্ত্তিকের মত বাউরি-কাঁটা চুল, একপাল বরাখুরে মোসাহেব, রক্ষিত বেশ্যা আর পাকান কাছা–জলস্তম্ভ আর ভূমিকম্পের মত—’কখনোর’ পাল্লায় পড়েছে!
কায়স্থ, ব্রাহ্মণ বড়মানুষ (পাড়াগেঁয়ে ভুতেরা ছাড়া প্রায় মাইনে-করা মোসাহেব রাখেন না; কেবল সহরে দু’চার বেণে বড়মানুষই মোসাহেবদের ভাগ্যে সুপ্রসন্ন। বুক-ফোলান, বাঁকা সীঁথি, পইতের গোছা গলায়, কুঁচের মত চক্ষু লাল, কাণে তুলোয় করা আতর (লেখাপড়া সকল রকমই জানেন, কেবল বিস্মৃতিক্রমে বর্ণপরিচয়টি হয় নাই) আমরা খালি বেণে বড় মানুষ বাবুদের মজলিশে দেখতে পাই।
মোসাহেবী পেশা উঠে গেলেই, ‘বারোইয়ারি’, ‘খেমটা’, ‘চেহেল’ ও ‘ফররার’ লাঘব হবে সন্দেহ নাই।
সন্ধ্যা হয় হয় হয়েচে–গয়লারা দুধের হাঁড়া কাঁধে করে দোকামে যাচ্ছে। মেছুনীরা আপনাদের পাটা, বঁটি ও চুবড়ি ধুয়ে প্রদীপ সাজাচ্ছে! গ্যাসের আলো-জ্বালা মুটেরা মৈ কাঁধে করে দৌডুচ্চে, থানার সামনে পাহারাওয়ালাদের প্যারেড (এঁরা লড়াই করবেন, কিন্তু মাতাল দেখে ভয় পান) হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের ভেটো কেরাণীরে ছুটি পেয়েছেন। আজ এ সময়ে বীরকৃষ্ণ দাঁর গদীতে বড় ধূম—বাবোইয়ারির অধ্যক্ষেরা একত্র হয়ে কোন কোন রকম সং হবে, কুমোরকে তারি নমুনা দেখাবেন, কুমোর নমুনো-মত সং তৈয়ের করবে, দাঁ মহাশর ও ম্যানেজার কানাইধন দত্তজা সমুনোর মুখপাত!
ফৌজদুরী বালাখানা থেকে ভাড়া করে এনে, কুড়িটি বেল লণ্ঠন (রং-বেরং—সাদা, গ্রিন, লাল) টাঙ্গান হয়েছে। উঠোনে প্রথমে খড়, তার উপর দরমা, তার উপর মাদরাজি খেরোর জাজিম হাসচে। দাঁড়িপাল্লা, চ্যাটা, কুলো ও চালুনীরে, গণিগব্যাগ ও ছেঁড়া চটের আশপাশ থেকে উঁকি-ঝুঁকি মাচ্চে—আর তারা ঘরজামাই ও অন্নদাস-ভাগ্নের দলে গণ্য।
বীরকৃষ্ণবাবু ধূপছায়া চেলীর জোড় এবং কলার-কপ ও প্লেটওয়ালা (ঝাড়ের গেলাশের মত) কামিজ ও ঢাকাই ট্যার্চ্চা কাজের চাদরে শোভা পাচ্ছে, রুমালখানি কোমরে বাঁধা আছে—সোনা চাবি-শিক্লী, কোঁচা ও কামিজের উপর ঘড়ির চেনের অফিসেয়েটিং হয়েছে।
পাঠক! নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মত অস্ত গেল। মেঘন্তের রৌদ্রের মত ইংরেজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। গবো মুন্সী, ছিরে বেণে ও পুঁটে তেলী রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আনা-সোটা ও রাজা খেতাপ, ইণ্ডিয়া রবরের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মত রাস্তায় পাঁদাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্পভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎ শেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগলো, তাই দেখে হিন্দুধৰ্ম্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো। হাফ-আখড়াই, ফুল-আখড়াই পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কলে, সহরের যুবকদল গোধুরী, ঝকমারী ও পক্ষীর দলে বিভক্ত হলেন। টাকা বংশগৌরবকে ছাপিয়ে উঠলেন। রামা মুদ্দফরাস, কেষ্টা বাগদী, পেঁচো মল্লিক ও ছুঁচো শীল ককেতার কায়েত-বামুনের মুরুব্বী ও সহরের প্রধান হয়ে উঠলো। এ সময়ে হাফ আখড়াই ও ফুল-অখিড়াইয়ের সৃষ্টি ও এই অবধি সহরের বড়মানুষেরা হাফ-আখাড়াইয়ে আমোদ কত্তে লাগলেন। শামবাজার, রামবাজার চক ও সাঁকোর বড় বড় নিষ্কর্মা বাবুর৷ এক এক হাফ-আখড়াই দলের মুরুব্বী হলেন। মোসাহেব, উমেদার, পাড়াস্থ ও দলস্থ গেরস্তগোছ হাড়হাভাতেরা সৌধীন দোহারের দলে মিশলেন। অনেকের হাফ-আখড়াইয়ের পুণ্যে চাকরী জুটে গেল। অনেকে পূজুরী দাদাঠাকুরের অবস্থা হতে একেবারে আমীর হয়ে পড়লেন—কিছুদিনের মধ্যে তকমা বাগান, জুড়ী ও বালাখানা বনে গেল!
আমরা পূর্ব্বে পাঠকদের যে বারোইয়ারি-পূজোর কথা বলে এসেচি, বীরকৃষ্ণ দাঁর উজ্জুগে প্রথম রাত্রি সেই বারোইয়ারিতলায় হাফ-আখড়াই হবে, তার উজ্জুগ হচ্ছে।
ধোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বর বাড়ীটিতে হাফ-আখড়াইয়ের দল বসেচে-বীরষ্ণেবাবু বগী চ’ড়ে প্রত্যহ আড্ডায় এসে থাকেন। দোহারেরা কুঠি থেকে এসে হাত-মুখ ধুয়ে জলযোগ করে রাত্রি দশটার পর একত্রে জমায়েৎ হন–ঢাকাই কামার, চাষাধোপা, পুঁটেতেলী ও ফলারে বামুনই অধিক। মুখুয্যেদের ছোটবাবু অধ্যক্ষ। ছোটবাবু ইয়ারের টেক্কা, বেশ্যার কাছে চিড়িয়ার গোলাম ও নেশায় শিবের বাবা! শরীর ডিগ্ডিগে, পুইতে গোচ্ছা ক’রে গলায়, দাঁতে মিশি, প্রায় আধহাত চেটালো কালা ও লালপেড়ে চক্ৰবেড়ের ধুতি পরে থাকেন। দেড়ভরি আফিম, দেড়শ ছিলিম গাঁজা ও একজালা তাড়ী রোজকী মৌতাতের উঠনো বন্দোবস্ত। পাল-পার্ব্বণে ও শনিবারে বেশী মাত্রা চড়ান!
অমাবস্যার রাত্রি–অন্ধকারে ঘুরঘুট্টি–গুড় গুড় করে নড়ছে না, মাটি থেকে যেন আগুনের তাপ বেরুচ্চে, পথিকেরা এক একবার আকাশ-পানে চাচ্ছেন, আর হন্ হন্ করে চলেচেন-কুকুরগুলো খেউ ঘেউ কচ্চে, দোকানীরে ঝাঁপড়া বন্ধ করে ঘরে যাবার উজ্জুগ কচ্চে,–গুডুম করে “নটার” তোপ পড়ে গেল। পোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বরের বাড়ী আজ বড়ই ধূম। ঢাকার বীরকৃষ্ণবাবু, চকবাজারের প্যালানাথবাবু, দলপতি বাবুয়ো ও দু-চার গাইয়ে ওস্তাদও আসবেন। গাওনার সুর বড় চমৎকার হয়েছে–দোহারেরাও মিলে ও তালে দোরস্ত।