হুজুর দেড়হাত উঁচু গদীর উপরে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে, গা আদুর! পাশে মুন্সীমশায় চসমা চোখে দিয়ে পেস্কারের সঙ্গে পরামর্শ কচ্চে—সামনে কতকগুলো খোলা থাতা ও একঝুড়ি চোতা কাগজ, আর একদিকে পাঁচজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত বাবুকে “ক্ষণজন্ম”, “যোগভ্রষ্ট” বলে তুষ্ট করবার অবসর খুঁজচেন। গদীর বিশ হাত অন্তরে দুজন বেকার ‘উমেদার’ ও একজন বৃদ্ধ কন্যাদায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠিক ‘বেকার’ ও ‘কন্যাদায়’ হালতের পরিচয় দিচ্চেন। মোসাহেবের খালি গায়ে ঘুর-ঘুর কচ্ছে, কেউ হুজুরের কাণে কাণে দু-চার কথা কচ্চেন—হুজুর ময়ূরহীন কার্ত্তিকের মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রয়েছেন। দত্তবাবু গিয়ে নমস্কার কললেন।
হুজুর বারোইয়ারি-পূজার বড় ভক্ত,পূজার কদিন দিবারাত্রি বারোইয়ারিতলাতেই কাটান। ভাগ্নে, মোসাহেব, জামাই ও ভগিনীপতি বারোইয়ারির জন্য দিনরাত শশব্যস্ত থাকেন।
দত্তবাবু বারোইয়ারি-বিষয়ক নানা কথা কয়ে হজুরি সবষ্ক্রিপসন হাজার টাকা বিদেয় নিলেন! পেমেন্টের সময় দাওয়ানজী শতকরা দু টাকার হিসাবে দস্তুরী কেটে ন্যান, দত্তজা ঘরপোড়া কাঠের হিসাবে ও দাওয়ানজীকে খুশী রাখবার জন্য তাতে আর কথা কইলেন না। এদিকে বাবু বারোইয়ারি পূজার ক-রাত্রি কোন্ কোন্ রকম পোষাক পরবেন, তার বিবেচনায় বিব্রত হলেন।
কানাইবাবু বারোইয়ারি-বই নিয়ে না খেয়ে বেলা দুটো অবধি নানা স্থানে ঘুরলেন, কোথাও কিছু পেলেন, কোথাও মস্ত টাকা সই মাত্র হলো; (আদায় হবে না, তার ভয় নাই), কোথাও গলা ধাক্কা, তামাসা ও ঠোনাটা-ঠানাটাও সইতে হলো।
বিশ বচ্ছর পূর্ব্বে কলকেতার বারোইয়ারির চাঁদা-সাধারা প্রায় দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা ছিলেন–ব্রহ্মোত্তর জমির খাজানা সাধরি মত লোকের উনোনে পা দিয়ে টাকা আদায় কত্তেন, অনেক চোটের কথা কয়ে, বড়মানুষেদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন।
একবার এক বারোইয়ারি-পাণ্ডারা এক চক্ষু কাণা এক সোণার বেণের কাছে চাঁদা আদায় কত্তে যান। বেণেবাবু বড়ই কৃপণ ছিলেন, “বাবার পরিবারকে” (অর্থাৎ মাকে) ভাত দিতেও কষ্ট বোধ কত্তেন, তামাক খাবার পাতের শুকনো নলগুলি জমিয়ে রাখতেল; একবৎসরের হলে ধোপাকে বিক্রী কত্তেন, তাতেই পরিবারের কাপড় কাচার দাম উসুল হতো। বারোইয়ারি-অধ্যক্ষেরা বেণেবাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে, তিনি বড়ই রেগে উঠলেন ও কোন মতে এক পয়সাও বারোইয়ারিতে বাজে খরচ কত্তে রাজি হলেন না। বারোইয়ারির অধ্যক্ষের ঠাউরে ঠাউরে দেখলেন, কিন্তু বাবুর বাজে খরচের কিছুই নিদর্শন পেলেন না; তামাক গুলি পাকিয়ে কোম্পানীর কাগজের সঙ্গে বাক্সমধ্যে রাখা হয়—বালিসের ওয়াড়, ছেলেদের পোষাক বেণেবাবু অবকাশমত স্বহস্তেই সেলাই করেন—চাকরদের কাছে (একজন বুড়ো উড়ে মাত্ৰ) তামাকের গুল, মুড়ো খেংরার দিনে দুবার নিকেশ নেওয়া হয়—ধুতি পুরণো হলে বদল দিয়ে বাসন কিনে থাকেন। বেণেবাবুর ত্রিশ লক্ষ টাকার কোম্পানীর কাজ ছিল; এ সওয়ায় সুদ ও চোটায় বিলক্ষণ দশ টাকা আসতো; কিন্তু তার এক পয়সা খরচ কত্তেন না; (পৈতৃক পেসা)। খাঁটি টাকায় মাকু চালিয়ে যা রোজগার কত্তেণ, তাতেই সংসারনির্ব্বাহ হতো; কেবল বাজে খরচের মধ্যে, একটা চক্ষু, কিন্তু চসমায় দুখানি পরকলা বসানো। তাই দেখে, বারোইয়ারির অধ্যক্ষেরা ধরে বলেন, “মশাই! আপনায় বাজে খরচ ধরা পড়েছে, হয় চসমাখানির একখানি পরকলা খুলে ফেলুন, নয় আমাদের কিছু দিন।” বেণেবাবু এ কথায় খুসী হলেন; অনেক কষ্টে দুটি সিকি পর্যন্ত দিতে সম্মত হয়েছিলেন।
আর একবার বারোইয়ারি-পূজোর এক দল অধ্যক্ষ সহরের সিঙ্গিবাবুদের বাড়ী গিয়ে উপস্থিত; সিঙ্গিবাবু সে সময় অফিসে বেরুচ্ছিলেন, অধ্যক্ষেরা চার-পাঁচ জনে তাহাকে ঘিরে ধরে ‘ধরেছি, ধরেছি’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গেল, সিঙ্গিবাবু অবাক্–ব্যাপারখানা কি? তখন একজন অধ্যক্ষ বল্লেন, “মশায়! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারিপূজোয় মা ভগবতী সিঙ্গির উপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিঙ্গির পা ভেঙ্গে গেছে; সুতরাং তিনি আর আসতে পাচ্ছেন না, সেইখানেই রয়েছেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন যে, যদি আর কোন সিঙ্গির যোগাড় কত্তে পার, তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়! আমরা আজ একমাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্চি, কোথাও আর সিঙ্গির দেখা পেলেন না। আজ আপনার দেখা পেয়েচি, কোন মতে ছেড়ে দেবো না–চলুন, যাতে মার আসা হয়, তাই তদ্বির করবেন। সিঙ্গিবাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে, বারোইয়ারির চাঁদায় বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য কল্লেন।
এ ভিন্ন বারোইয়ারির চাঁদা-সাধা বিষয়ে নানা উদ্ভট কথা আছে। কিন্তু এখানে সে সকলের উত্থাপন নিষ্প্রয়োজন। পূৰ্ব্বে চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি-পূজা আর কোথাও হতো না, “আচাভো’, ‘বোম্বোচাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হতে; সহরের ও নানাস্থলের বাবুরা বোট, বজরা, পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন। লোকের এত জনতা হতো যে, কলপাত এক টাকায় একখানি বিক্রী হতো, চোরেরা আণ্ডীল হয়ে যেতো; কিন্তু গরীব, দুঃখী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়তো না। গুপ্তিপাড়া, কাঁচড়াপাড়া, শান্তিপুর, উলো প্রভৃতি কলকেতার নিকটবর্তী পল্লীগ্রামে ক’বার বড় ধুম করে বারোইয়ারি-পূজো হয়েছিল। এতে টক্করাটক্করিও বিলক্ষণ চলেছিল। একবার শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে এক বারোইয়ারি-পূজো করেন; সাত বৎসর ধরে তার উজ্জুগ হয়, প্রতিমাখানি ষাট হাত উঁচু হয়েছিল। শেষে বিসর্জ্জনের দিনে প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে বিসর্জ্জন কত্তে হয়েছিল, তাতেই গুপ্তিপাড়াওয়ালার ‘মার’ অপঘাতমৃত্যু উপলক্ষে গণেশের গলায় কাচা বেঁধে এক বারোইয়ারি পূজো করেন, তাতেও বিস্তর টাকা ব্যয় হয়!