মাতা মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তারা যে তোদের মুরীদান, তাদের বাড়ি যাবি? শেষকালে যদি…
আবদুল্লাহ্ বাধা দিয়া কহিল, ওঃ, আমি বুঝি সেখানে খোনকারী করতে যাব! এমনি যাব মেহমানের মতো। একবেলা একটু জিরিয়ে আবার বেলা পড়লে বেরিয়ে পড়ব!
যদি তারা সালামী টালামী দেয়?
দিলেই অমনি নিয়ে নিলুম আর কি!
তারা যে তা হলে বড্ড বেজার হবে, বাবা।
তা হলে আর কী করব, আম্মা। যতদূর পারি তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে।
এমন সহজলভ্য উপজীবিকা যাহাদের চিরদিনের অভ্যাস, অতি সামান্য হলেও তাহাদের পক্ষে উহার আশা পরিত্যাগ করা কঠিন, তাই মাতা মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হইলেন। এখনো যদি আবদুল্লাহ একবার মুরীদানে গিয়া ঘুরিয়া আসে, তাহা হইলে তাহার পড়ার ভাবনা থাকে। না। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হইবে না; অগত্যা তিনি ভাবিলেন, থাক, যে কাজে উহার মন যায় না সে কাজের জন্য পীড়াপীড়ি করা ভালো নহে। খোদা অবশ্যই একটা কিনারা করিয়া দেবেন। আবদুল্লাহর ইচ্ছা ছিল একটু বেলা হইলে ধীরেসুস্থে বাটী হতে বাহির হইবে; কিন্তু মাতার পীড়াপীড়িতে ফজরের নামায বাদেই তাহাকে দুটি খাইয়া রওয়ানা হইতে হইল।
একবালপুর তাহাদের বাটী হইতে আট ক্রোশ। পিতা বাঁচিয়া থাকিতে আবদুল্লাহকে কখনো এতটা পথ হাঁটিয়া যাইতে হয় নাই; গরুর গাড়ি অথবা কোনো কোনো সময়ে পালকি করিয়া সে শ্বশুরালয়ে যাতায়াত করিয়াছে। কিন্তু এক্ষণে টানাটানির সংসারে মিতব্যয়িতার নিতান্ত দরকার বুঝিয়া সে হাঁটিয়াই চলিয়াছে। মাতা অনেক পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন; দুই-এক টাকা গাড়ি ভাড়া দিলে কতই-বা টানাটানি বাড়িত! কিন্তু সে কিছুতেই গাড়ি লইতে রাজি হয় নাই।
গ্রামখানি পার হইয়াই আবদুল্লাহ্ এক বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে আসিয়া পড়িল। তখন শরৎকাল প্রায় হইয়া আসিয়াছে। মাঠগুলি ধান্যে পরিপূর্ণ; মৃদুমন্দ বায়ু হিল্লোলে তাহাদের শ্যামল হাস্য ক্ষণে ক্ষণে তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিতেছে। এই অপূর্ব নয়নতৃপ্তিকর দৃশ্য দেখিতে এবং শারদীয় প্রভাতের সুখ-শীতল সমীরণের মধুর স্পর্শ অনুভব করিতে করিতে আবদুল্লাহ্ মাঠের পর মাঠ এবং গ্রামের পর গ্রাম পার হইয়া চলিতে লাগিল।
ক্রমে বেলা বাড়িয়া উঠিল, এবং ক্লান্ত পথিকের পক্ষে হৈমন্তিক রৌদ্রও অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। সুতরাং তিন-চারি ক্রোশ পথ আঁটিবার পর শ্রান্তি দূর করিবার জন্য আবুদল্লাহ্ এক মাঠের প্রান্তে বৃক্ষতলে বসিয়া পড়িল।
কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পর যখন তাহার মন বেশ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, তখন নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নানা কথা মনে উঠিতে লাগিল। এতদিন সে যে উচ্চ আশা হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছিল, তাহা সফল হইবার সম্ভাবনা না থাকিলেও, ক্লান্তদেহে আজ বটবৃক্ষতলে বসিয়া সে মনে মনে ভবিষ্যতের যে চিত্রটি আঁকিতেছিল, তাহা নিতান্ত উজ্জ্বলতাহীন নহে। সে ভাবিতেছিল চাকরি তাহাকে করিতেই হইবে, আর কোনো উপায় নাই। সরকারি চাকরি তো পাওয়া কঠিন, মুরব্বি না ধরিতে পারিলে সামান্য কেরানীগিরিও জুটিবে না। কিন্তু মুরব্বি কোথায় পাইবে? কাহাকে ধরিবে? সোজাসুজি গিয়া সাহেব সুবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া একবার চেষ্টা করিয়া দেখা যাইতে পারে। কিন্তু কী চাকরির জন্য চেষ্টা করিবে? পুলিশের? –নাঃ, ও চাকরিটা ভালো নয়। সবরেজিস্ট্রারি?–ওটা পাওয়া বড় কঠিন না হইতে পারে; কত এট্রেন্স ফেল সবরেজিস্ট্রার হইতেছে, কিন্তু অনেক দিন এপ্রেন্টিসি করিতে হয়; ততদিন চলিবে কিসে? একটা মাস্টারি পাইলে মন্দ হয় না; ত্রিশ কি চল্লিশ টাকা মাহিনা পাওয়া যাইতে পারে, চাই কি একটা টুইশন যোগাড় করিতে পারিলে আরো দশ-বিশ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আরো বিশেষ সুবিধা এই যে, মাস্টারি করিতে করিতে বি. এ. পরীক্ষাটার জন্য প্রস্তুত হওয়া যাইবে। এটা মস্ত লাভ। আর কোনো চাকরিতে এই সুবিধাটা হইবে না। শ্বশুর তো সাহায্য করিবেনই না, তাহা জানা আছে; কেবল আম্মাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য। একবার তাহার কাছে যাওয়া। তা তিনি সাহায্য না-ই করিলেন, পরের সাহায্য গ্রহণ না করিতে হইলেই ভালো। আবদুল্লাহ মাস্টারি করিবে; বি. এ. পাস করিয়া তাহার চিরদিনের ঐকান্তিক বাসনা পূর্ণ করিয়া জীবন সফল করিবে। হাতে কিছু টাকা জমাইয়া আবার। কলিকাতায় দুই বৎসর আইন পড়িবে–এখানেও একটি টুইশন যোগাড় করিয়া লইবে। পাস করিয়া যখন সে ওকালতি আরম্ভ করিবে তখন আর ভাবনা কী?–চাই কি, তখন দেশের কাজে, সমাজের কাজে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যাইবে। ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, স্ত্রী-শিক্ষার প্রবর্তন প্রভৃতি ব্যাপারে সে জীবন উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইবে। এই সকল সংস্কার সুসম্পন্ন না হইলে, বিশেষত যতদিন স্ত্রী-শিক্ষা সমাজে প্রচলিত করা না যাইতেছে, ততদিন মুসলমানদের কুসংস্কারের আবর্জনা দূর হইবে না; এবং তাহা না হইলে সমাজের উন্নতি একেবারেই অসম্ভব। আবদুল্লাহ্ মনে মনে স্থির করিয়া ফেলিল যে, খোদা যদি দিন দেন, তবে স্ত্রী-শিক্ষার জন্য তাহার যথাসর্বস্ব পণ করিয়া ফেলিবে!
এইরূপ সুমহৎ সঙ্কল্প করতে করিতে হঠাৎ আবদুল্লাহর চৈতন্য হইল যে, বেলা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। শাহপাড়ায় পৌঁছিতে এখনো এক ক্রোশ পথ বাকি, কাজেই তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহাকে আবার পথ লইতে হইল।