.
৪১.
সৈয়দ সাহেবের মৃত্যুর পর হইতে পাওনাদারদের তাগাদা অগ্রাহ্য করিয়া তার উভয় পক্ষের নাবালক সন্তানসন্ততিকে অসহায় অবস্থায় ফেলিয়া আবদুল মালেক সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি শরীফাবাদে গিয়া নিশ্চিন্ত মনে বহাল তবিয়তে কালাতিপাত করিতেছেন। অবশ্য ইহার যে কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না, তাহা নহে। অভাব এত বেশি হইয়া উঠিয়াছিল যে বাড়িতে আদৌ মান-সম্ভম বজায় রাখিয়া চলিবার কোনো উপায় ছিল না। তার ওপর ছেলেপুলের অসুখবিসুখ, তাহাদের চিকিৎসাপত্র হইবে কেমন করিয়া? সেবা-শুশ্রূষারও একান্ত অভাব, কারণ দাসী-বাদী যাহারা ছিল, নিয়মিত ভরণপোষণ না পাইয়া যে যাহার পথ দেখিয়া লইয়াছে, কাজেই শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ ভিন্ন তাহার গত্যন্তর ছিল না।
এখন বাড়ির কর্তা হইয়াছিল খোদা নেওয়াজ। বেচারা একাধারে চাকর ও কর্তা। বাঁদী-পুত্র বলিয়া লেখাপড়া শিখিবার সুযোগ পায় নাই। কাজেই একজন গোমস্তার ওপর আদায়পত্রের ভার ছিল। সে যাহা দয়া করিয়া দেয় তাহারই ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা ছাড়া তাহার গতি ছিল না। সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছে যে তাহাকে যথেষ্ট ঠকানো হইতেছে। কিন্তু উপায় ছিল না।
এদিকে ভোলানাথবাবুর শরীরও ইদানীং ভালো ছিল না। তিনি সেই মাদারগঞ্জ ও রসুলপুর এই দুইটি তালুকের একটা ব্যবস্থা করিয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। এবং মাঝে মাঝে কড়া তাগিদও পাঠাইতেছিলেন। খোদা নেওয়াজ দুঃখ করিয়া বলিত, আর কি ও ঋণ পরিশোধ হবার যো আছে! ও আপনাদেরই হয়ে গেল।
মধ্যে কয়েক মাস আদৌ আর কোনো তাগিদ আসিল না। খোদা নেওয়াজের মনের ভিতর একটা সন্দেহ জাগিয়া উঠিল; কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতেও পারে না আবার না করিলেও স্থির থাকিতে পারে না। অবশেষে একদিন সকল রহস্য প্রকাশ হইয়া পড়িল, আদালতের এক কর্মচারীর মুখে। ভোলানাথবাবুর পুত্র হরনাথবাবু ঋণের টাকার জন্য নালিশ রুজু করিয়াছেন এবং শীঘ্রই সুদে-আসলে সমস্ত টাকার ডিক্রি হইয়া যাইবে। সংবাদ শুনিয়া খোদা নেওয়াজ মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
হইলও তাই। যথাসময়ে হরনাথবাবু আদালত হইতে খরচসমেত সুদে-আসলে সমস্ত টাকার ডিক্রি পাইলেন। সংবাদ যখন একবালপুরে পৌঁছিল, তখন সকলের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। ছোট বিবি জ্বরগায়ে কাঁপিতে কাঁপিতে ঘর ঝাঁট দিতেছিলেন। কন্যাটি ঘরের মেঝেয় বসিয়া বাসি তরকারি দিয়া গরম ভাত খাইতেছিল। বড়বিবি বলিলেন, ওমা, ওর গায় দেখি জ্বর, ওকে বাসি তরকারি দিয়ে ভাত খেতে দিলে কী বলে! ছোটবিবি ধীর শান্তভাবে বলিলেন, বেলা দুপুর হয়ে গেল, কাল থেকে কিছু খায় নি, কী করি! বললাম নুন দিয়ে খা, তা কি শোনে!
কেন একটু মিছরি দিয়ে দিলে না?
পেট ভরা পিলে, খালি পেটে মিষ্টি খাওয়া কি ভালো, তাই দিনি। আর মিছরি তাও কি ঘরে আছে; থাকলে তো দেব!
এমন সময় খোদা নেওয়াজ হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া বলিল, আম্মাজান, কাল নাকি তালুক দুটা নিলামে চড়বে। ছোটবিবি শুনিয়াও শুনিলেন না, কাঁপিতে কাঁপিতে ঘর ঝট দিয়াই চলিলেন। বড়বিবি যেন তাহার বিশেষ কিছু আসে যায় না এমনিভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, কে বল্লে, তুই কোত্থেকে শুনে এলি? চিঠি দেখে নাকি?
খোদা নেওয়াজ কিন্তু কী করিবে ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছিল না। অবশেষে সে স্নানাহার মুলতুবি রাখিয়া মধ্যাহ্ন মার্তণ্ডের প্রখর রৌদ্র অগ্রাহ্য করিয়া এক কাপড়েই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িল এবং বেলা ডুবুডুবু সময়ে রসুলপুর গিয়া উপস্থিত হইল।
আবদুল্লাহ্ সব শুনিয়া ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝিয়া রাত্রিতেই একবালপুর পৌঁছিল এবং আবদুল খালেককে সঙ্গে লইয়া পরদিন প্রত্যুষেই বরিহাটী যাত্রা করিল।
হরনাথবাবুর এখন অসীম প্রসার-প্রতিপত্তি, কিন্তু তাই বলিয়া এতগুলি টাকা ছাড়িয়া দেওয়ার কথা তাকে বলা অন্যায় হইবে ভাবিয়া আবদুল্লাহ্ কিছুদিন সময় প্রার্থনা করিল।
হরনাথবাবু বলিলেন, আর কতদিন অপেক্ষা করা যায়! একেবারে টাকাগুলা মারা যায়, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে এ-কাজ করতে হয়েছে। তা যদি বড় মিয়া সাহেব (আবদুল মালেক বাড়ি থেকে নিজে দেখেশুনে) আদায়-পত্র করতেন এবং কিছু কিছু করে টাকাটা আদায় হত তা হলে আর ভাবনা কী ছিল! তা তিনি তো শুনেছি শ্বশুরবাড়িতেই আজকাল আছেন। এখন আপনারাই বলুন, কী ভরসায় আমি বসে থাকি?
আবদুল্লাহ্ কহিল, আপনারা বড়লোক। সৈয়দ সাহেবদের অবস্থা তো জানেনই। একটি বিশেষ সম্ভ্রান্ত পরিবার পথের কাঙাল হবে! দয়া করলে একটা উপায় হতেই পারে।
হরনাথবাবুর করুণ হৃদয় মথিত হইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হইল, তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, সৈয়দ সাহেবকে আমি দেখেছি। এমন উদারচেতা লোক আজকাল অতি বিরল। একবার বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কত খাতির করলেন বাবাকে ও আমাকে! তার গোমস্তা ৮০০ টাকা তহবিল তসরুফ করেছিল, বাবার অনুরোধে এক কথায় তিনি মা লিখে দিলেন। ভগবান এমন একটি উদারচেতা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সন্তানসন্ততির ভাগ্যে এত দুঃখ কেন লিখলেন বুঝি না। তা যা হোক আপনারা এসেছেন; আমি না হয় সুদটা ছেড়ে দিতে পারি; কিন্তু আসল টাকাটা–
আবদুল খালেক একটু নড়িয়া বসিল এবং চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া হরনাথবাবুর দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল।