বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন উপলক্ষে রাত্রি জাগরণ, তার ওপর মানসিক অশাস্তি ও উদ্বেগ ভগ্নস্বাস্থ্য মীর সাহেব সহ্য করিতে পারিলেন না। সেইদিন দ্বিপ্রহরে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হইলেন। একটু সর্দিকাশি পূর্বেও দেখা দিয়াছিল। রাত্রে বুকে-পিঠে বেদনা অনুভব করিলেন। মীর সাহেব ভাবিলেন আর সময় নাই। নানারূপ ভাবিয়া পরদিন বাদশা মিঞাকে এই মর্মে একখানা চিঠি লিখিয়া পাঠাইলেন যে, টাকাটা লোন-আপিসেই ছিল কিন্তু সে টাকা লোন আপিস হইতে উঠাইয়া তদ্বারা মালেকার নামেই একটি খুব লাভবান সম্পত্তি খরিদ করা হইয়াছে।
.
৪০.
বিবাহ উপলক্ষে আবদুল খালেক সপরিবারে রসুলপুরে উপস্থিত ছিল। আবদুল্লাহ্ ও আবদুল খালেক উভয়েই উপযুক্ত ডাক্তারকে ডাকিয়া মীর সাহেবের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করিল। এদিকে মালেকা ও রাবিয়ার প্রাণপণ সেবা-শুশ্রূষাও চলিতে লাগিল। খোদার মরজিতে অল্পদিনের মধ্যেই মীর সাহেব আরোগ্য লাভ করিয়া উঠিলেন।
মীর সাহেব অসুস্থ থাকাকালীন আবদুল্লাহ্ তাহার বাড়িতে অনবরত আসা-যাওয়া করিত। মালেকার সেবা-শুশ্রূষার নিপুণতার বহু পরিচয় আবদুল্লাহ্ পাইয়াছিল এবং মালেকার প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মানে তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। বুদ্ধিমতী রাবিয়াও ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল। সে মনে মনে উভয়ের মধ্যে সম্বন্ধ স্থির করিবার সঙ্কল্প করিল।
মীর সাহেব আরোগ্য লাভ করায় সকলেই অত্যন্ত সুখী হইয়াছিল। কয়েকদিন পর একটু আয়োজন করিয়াই সবাই মিলিয়া একসঙ্গে খাবার বন্দোবস্ত করিল। এদিকে মীর সাহেব মালেকার চিন্তায় আকুল হইয়া উঠিয়াছিল।
সেদিন আহারাদির পর রাবিয়া আবদুল্লাহ্কে ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল। সেদিন সকলেরই মন বেশ প্রফুল্ল ছিল। রাবিয়া আবদুল্লাহর সম্মুখে সাজা পানভরা পানের বাটা রাখিয়া দিতেই আবদুল্লাহ্ কহিল, ভাবীসাহেবা, আমি পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
রাবিয়া বলিল, কেন, এত বৈরাগ্য কিসের জন্য?
বৈরাগ্য আর কী, ভালো লাগে না, তা ছাড়া পান খেলে অপকার হয়–আবার মাস্টারি করি কিনা, ছেলেপুলের সামনে পান খাওয়াটা ভালো নয়; তাই আজকাল ওটা ছেড়েই দিয়েছি!
আচ্ছা, পান খাওয়া না হয় ছেড়েই দিলেন, তাই বলে সব ছাড়তে পারবেন না। সত্যিই খোনুকার সাহেব, বলুন দেখি এমনভাবে আর কতদিন কাটবে!
আপনার কথাটা বুঝতে পারলাম না।
কথাটা কি এতই শক্ত যে বুঝা কঠিন! তবে সোজা করে বলি। আপনি আপনার লোক, কিন্তু কেন জানি না, আপনাকে আরো কাছে টেনে নিতে বড় ইচ্ছা হয়। যদি সত্যি সত্যি আমার মনটা বার করে আপনাকে দেখাতে পারতাম তা হলে আপনি বুঝতে পারতেন…
আবদুল খালেক পাশের ঘরে সমস্ত কথাই শুনিতেছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, বাঃ, বেশ তামাশা হচ্ছে, আর আমি যে এ ঘরে ওত পেতে রয়েছি তার খোঁজ আছে?
রাবিয়া ঘোমটা একটু টানিয়া দিয়া বলিল, তামাশা নয়; সত্যি কথা। তাহার চক্ষু ছলছল করিতেছিল। বলিল, খোকার সাহেবকে মামুজান এত স্নেহ করেন দেখে আমার বড় ইচ্ছা হয়…।
আবদুল খালেক, কী ইচ্ছা, মালেকাকে ঘাড়ে চাপাতে চাও, না! আমি বলে দিলাম মনের কথাটা।
রাবিয়া, চাই, চাব না কেন? আপনার লোকের বোঝা আপনার লোকের উপর চাপাতে পারলে কে ছাড়ে? কিন্তু চেলেই যদি পারতাম তা হলে আর বিলম্ব করতাম না। তা সে আমাদের কি আর সেই কপাল হবে!
আবদুল্লাহ্ একটু যেন লজ্জিত হইল। আবদুল খালেক তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিল, কী। হে খোকার? মনটা কি নরমে উঠেছে? তা আমি তো বলি কাজটা করলে মন্দ হয় না।
আবদুল্লাহ্ এবার গম্ভীর হইয়া উঠিল। তার জীবনের অনেক কথা তার মনে দ্রুত খেলিয়া যাইতে লাগিল। সেদিন স্কুলে একটি ইংরেজি কবিতা পড়াইতে ছিল, … Life is real Life is earnest সে কথাও মনে হইল। চন্দ্রশেখর বাবুর কথা, জলধর সেনের কথা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ সমর্থনের কথা, নূরজাহান, তাজমহল, কত কথাই তাহার মনে হইল।
মীর সাহেব ব্যাপার কিছু কিছু শুনিলেন। অবশেষে আবদুল্লাহ্ মীর সাহেবের নিকট নিজেই জানাইল যে, যদি তিনি মুরব্বিস্বরূপ আবদুল্লাহকে পরামর্শ দেন এবং যদি তিনি সুখী হন তাহা হইলে আবদুল্লাহ্ এই বিবাহে রাজি।
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আবদুল্লাহর মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে মীর সাহেব হঠাৎ তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া কাছে বসাইয়া পিঠে মাথায় হাত বুলাইয়া অজস্র আশীর্বাদে তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিলেন।
বিনা আড়ম্বরে শুভদিনে শুভক্ষণে আবদুল্লাহর সহিত মালেকার বিবাহ হইয়া গেল।
মীর সাহেব যেন তার শেষ কর্তব্যটি সম্পন্ন করার জন্য এতদিন মনের কথা মনেই রাখিয়া দিয়াছিলেন। সুদখোর মীর সাহেব যে মনে মনে এতখানি কল্পনা করিয়াছিলেন তাহা কেহ পূর্বে ভাবে নাই। বাদশা মিঞার সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া কলিকাতা হাইকোর্ট হইতে একজন উকিল আনাইয়া সুদখোর মীরসাহেব তার সমস্ত সম্পত্তির ওয়াকফনামা লিখিয়া রেজিস্ট্রি আপিসে গিয়া রেজিষ্ট্রি করিয়া দিলেন। তার পরিত্যক্ত যাবতীয় সম্পত্তি lo আনা সাধারণ শিক্ষার জন্য, ॥O আনা শিল্পশিক্ষার জন্য, l0 আনা আতুর-সেবার জন্য, l0 আনা একটি পান্থশালার ব্যয়ের জন্য, বাকি l0 আনার জন্য l0 আনা মোতওয়াল্লীর মোশাহেরা দরুন এবং 0 আনা অন্যান্য কর্মচারীর বেতনের দরুন ব্যয় হইবে। আয়-ব্যয় হিসাব করিয়া দেখা গেল l0 আনা সম্পত্তির বার্ষিক আয় প্রায় ৪০০০ টাকা হয় অর্থাৎ সম্পত্তির মোট আয় ৬৪০০০ টাকা ছিল। আবদুল্লাহ্ আপাতত মোতওয়াল্লীর পদে নিযুক্ত হইল।