হরনাথবাবু সমস্ত শুনিয়া অবশেষে মীর সাহেবকে বলিলেন, আচ্ছা, আপনার অনুরোধ আমি কখনো ভুলব না এবং যথাসাধ্য আলতাফকে সাহায্য করব। আজই সন্ধ্যায় কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করার কথা। তখনই আমি কথাটা পাড়ব। কাল সকালেই একবার আলতাফ ভায়াকে পাঠিয়ে দেবেন আমার এখানে, যা কথা হয় জানাব। যদি কালেক্টর সাহেবকে সম্মত করতে পারি তা হলে দাদা আছেন এখন কমিশনারের পার্সন্যাল এসিসটেন্ট, তারও কাছে একটা চিঠি দিয়ে আলতাফকে পাঠিয়ে দেব। যতদূর যা পারি আমি নিশ্চয়ই করব, আর কিছুর জন্য না হয় শুধু আপনার খাতিরে।
পরদিন প্রত্যুষে আলতাফ হরনাথবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়া জানিল যে কালেক্টর সাহেব বলিয়াছেন যে, কয়েকজন খুব ভালো ভালো প্রার্থী আছে; তিনি কোনোরূপ প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন না, তবে আলতাফকে একবার দেখিতে চান।
সেইদিনই হরনাথবাবুর একখানা পত্র লইয়া আলতাফ যথাসময়ে কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করিল। কালেক্টর সাহেব বলিলেন, আলতাফের আরো কিছু পূর্বে দেখা করা উচিত ছিল, কারণ তিনি পূর্বেই একজনকে একরূপ কথাই দিয়াছিলেন। এখন ডিপুটিগিরির জন্য প্রথম নাম (first nomination) তিনি দিতে অক্ষম তবে সবুডিপুটির জন্য প্রথম নাম এবং ডিপুটিগিরির জন্য দ্বিতীয় নাম দিতে চেষ্টা করিবেন বলিয়া আলতাফকে জানাইলেন।
মীর সাহেব সমস্ত কথা শুনিলেন এবং রসুলপুর ফিরিয়া আসিয়া বাদশা মিঞার সহিত পাকাপাকি কথা ঠিক করিয়া দিন স্থির করার প্রস্তাব করায় বাদশা মিঞা নানারূপ অজুহাত দেখাইয়া সময় লইতে চাহিলেন। বাদশা মিঞার মনের অভিসন্ধি যে, আলতাফের চাকরির চেষ্টার ফলাফল জানার পূর্বেই যদি সম্বন্ধ স্থির হইয়া যায় তবে হয়তো মীরের পো সরিয়া পড়িবেন এবং আলতাফের চাকরির তদ্বিরের দরুন আর্থিক সাহায্য শেষ পর্যন্ত নাও করিতে পারেন! মীর সাহেব যে এতদিন কোনো বিশেষ মতলবেই আলতাফের খরচ যোগাইতেছিলেন এইরূপ সন্দেহ আর যে যাই বলুক বাদশা মিঞার মনে বরাবরই ছিল। কোনো সমাজ যখন অধঃপাতে যায় তখন সেই সমাজে যে দুই-একটি ভালো লোক নিঃস্বার্থভাবে পরের উপকার করে তাদের মনের কথা বিচার করিবার সময় অধঃপতিত জন নিজের মনের প্রতিবিম্ব ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পায় না। কৃতজ্ঞতা জিনিসটির অধঃপতিত সমাজে কোনো স্থান নাই। মীর সাহেবের অবশ্য কৃতজ্ঞতার দিকে তত লোভ ছিল না। তিনি সমাজকে ভালো করিয়াই চিনিয়াছিলেন। বাদশা মিঞা কেন যে দিন স্থির করিতে নারাজ তাহা তিনি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিলেন। অবশেষে যখন বাদশা মিয়া একটু দূরে অর্থাৎ ডিপুটিগিরির চেষ্টার ফলাফল প্রকাশিত হইবার পর বিবাহের দিন স্থির করিলেন মীর সাহেব তাহাতেই রাজি হইলেন।
.
৩৯.
যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশিত হইল এবং আলতাফ সব্ডিপুটির নিয়োগপত্র পাইল। বাদশা মিঞা একেবারে চটিয়া লাল। তিনি আরো শুনিয়াছিলেন যে, মালেকাকে মীর সাহেব ৫০০০ টাকা দিয়াছেন সে কথাও মিথ্যা। বাদশা মিঞা চটিয়া বলিলেন, সব জুরি–ডিপুটি করে দেবে বলেছিল, হল কিনা সবুডিপুটি–টাকার বেলাতেও ফাঁকি–সব চালাকি! কিন্তু তিনি মীর সাহেবকে মনের কথা কিছু জানাইলেন না। ভিতরে ভিতরে কূট মতলব করিয়া বসিলেন, আলতাফের বিবাহের সময় এই জুজুরির সমুচিত প্রতিশোধ দিবেন। তাহাকে লোকচক্ষে এমনভাবে অপদস্থ করিবেন, যাহাতে জীবনে কখনো আর লোকের কাছে মুখ দেখাইতে না পারেন।
এদিকে আলতাফকে বরিহাটীতে কার্যে যোগদান করিতে হইবে। অথচ বিবাহের দিন নিকটবর্তী। রসুলপুরে বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন চলিতেছে। সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক। লোকজনকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে। গত রাত্র হইতে নিমন্ত্রিতদের খানার যথারীতি আয়োজন চলিয়াছে। ২০/২৫ জন লোক যাদের ওপর পাকের ভার ছিল তারা সারারাত্রি জাগিয়া পাকের আয়োজন করিয়াছে। পোলাও, মাংস ইত্যাদি কতক কতক পাক হইয়া গিয়াছে। মীর সাহেব অসুস্থ শরীরে প্রায় রাত্রি দুটা পর্যন্ত জাগিয়া সকলের অনুরোধে একটু ঘুমাইয়া আবার ফজরে উঠিয়া নামায সমাধা করিয়া কাজকর্ম দেখিতেছেন। ক্রমে বেলা উঠিল। বরের আসিবার সময় সন্নিকট। দু-দশজন নিমন্ত্রিতরা আসিতে আরম্ভও করিয়াছে। মীর সাহেব হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনা করিতেছেন। এমন সময় ডাকপিয়ন আসিয়া একখানা চিঠি হাতে দিল। মীর সাহেব ক্ষিপ্রহস্তে চিঠিখানা লইয়া পড়িয়া একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। সকলে অবাক! ব্যাপার কী জানিবার জন্য মীর সাহেবের চারিদিকে ভিড় জমাইল। ছলছল-চক্ষু বৃদ্ধ মীর সাহেব বুকে পাষাণ বাধিয়া সকলকে জানাইলেন, বাদশা মিঞা চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে এ বিবাহ হতে পারে না, কারণ আমি নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আলতাফকে ডিপুটি করে দেব কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আমি তাকে সব্ডিপুটি মাত্র করেছি। হা কপাল, ডিপুটিগিরি কেন, যদি তার বড় কিছু আমার হাতে থাকত আমি আলতাফকে তাও দিতে পারলে কি ছাড়তাম? আলতাফ, তোমার হাতে আমার এই শাস্তি, এ তো আমি স্বপ্নেও কল্পনা করি নি! আমার পুত্র পরিবার কেউ নাই। তোমরাই আমার সব! কবে কোনদিন আলতাফকে কী দিতে আমি কুণ্ঠিত হয়েছি তা খোদাতালা ছাড়া আর কেউ জানেন না। বৃদ্ধের গণ্ড বাহিয়া কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরিল।