স্থিরসঙ্কল্প হইয়া সৈয়দ সাহেব আবদুল মালেককে রসুলপুরে পাঠাইয়া দিলেন। আবদুল মালেক রসুলপুরে পৌঁছিয়া সাংসারিক অভাব-অনটনের কথা যাহা কিছু বলিবার সমস্তই আবদুল্লাহকে বলিল এবং শীঘ্রই যাহাতে life insure-এর টাকাটার ন্যায্য প্রাপ্যটা পাওয়া যায় তাহার যথাবিহিত চেষ্টা করিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইল।
আবদুল্লাহ আপত্তির কোনো কারণ দেখিতে পাইল না। কাজেই যত শীঘ্র সম্ভব সে একটা ব্যবস্থা করিয়া ফেলিবে–এই প্রতিশ্রুতি দিয়া আবদুল মালেককে একবালপুরে পাঠাইয়া দিল।
.
৩৭.
বাস্তবিকই সৈয়দ সাহেবের শরীর অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িয়াছে। পুত্র আবদুল কাদেরের মৃত্যু-সংবাদে তিনি আরো বেশি কাহিল হইয়া পড়িলেন। তার ওপর দুশ্চিন্তার বোঝাও ক্রমে বাড়িয়া উঠিয়াছে। আবদুল কাদেরের মৃত্যুতে কিস্তি খেলাপ হওয়ায় ভোলানাথবাবুরাও কিছু চাঞ্চল্য দেখাইতেছেন। টাকাটা শোধ না দিলে ভালো ভালো দুটা তালুক বেহাত হইয়া যাইবার সম্ভাবনায় আবদুল মালেকও অনেকটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। আবদুল মালেক সেদিন আসরের নামায বাদ সৈয়দ সাহেবের সম্মুখীন হইয়া বলিল, আহ্বা, মনে মনে ভাবছি আবদুল কাদেরের লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দরুন যে টাকাটা পাওয়া যাবে তা ধরুনগে তাতে তো আপনারও হক আছে; সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন, তা আছে, তাতে তুমি কী বলছ?
আবদুল মালেক, বলব আর কী, ধরুনগে আপনার মাদারগঞ্জ আর রসুলপুর ওই দুটাই। তো হল ভালো তালুক; ও দুটা গেলে ধরুনগে আপনার আর রইল কী?
সৈয়দ সাহেব একটু উষ্ণ হইয়া বলিলেন, তা তুমি কী বলছ খোলসা করে সোজা বল না। ওসব ঘোরপ্যাঁচ কেন?
আবদুল মালেক, আমি বলছি যে আপনার যখন শরা-মতো হক আছে তখন ধরুনগে আপনার যে টাকাটা আপনি পাবেন…।
সৈয়দ সাহেব, হ্যাঁ, পাব, তাতে কী? তুমি বলছ সেই টাকাটা ভোলানাথবাবুকে দিয়ে ঋণটা শোধ দেওয়া যাবে!
আবদুল মালেক, তা যাবে বৈকি! আবদুল কাদের মরহুম তো প্রায় হাজার দেড়েক টাকা শোধ দিয়ে গেছে।
সৈয়দ সাহেব, হাজার দেড়েক না, তবে কাছাকাছি, অনেকটা টাকা তো সুদের বাবদ গেছে কিনা? তা যা হোক, লাইফ ইস্যুরেন্সের কত টাকা?
পাঁচ হাজার; তা তার দুই আনা হল কত ছয় শত সাড়ে ছয় শত হবে। তাতে কি আর ঋণ শোধ হবে? তা যা হোক, তুমি আবদুল্লাহকে চিঠি লিখে দাও। বড় টানাটানি চলছে।
যথাসময়ে ওই মর্মে আবদুল্লাহর নিকট পত্র প্রেরিত হইল এবং আবদুল্লাহ্ যথাসময়ে শরা-মতো সৈয়দ সাহেবের দাবি গ্রাহ্য করিয়া ৬৩৩।৩ টাকা পাঠাইয়া দিল।
টাকা হস্তগত হওয়ায় সৈয়দ সাহেবের সওয়াব হাসিল করার আবার একটি বিশেষ সুযোগ উপস্থিত হইল। পীর সাহেবের পুত্রের শাদি-মোবারকের দাওয়াদ পৌঁছিয়াছিল এবং যত্র আয় তত্র ব্যয়। সমস্ত টাকাই পীরসাহেবের ছেলের বিবাহের নজর ইত্যাদিতে খরচ হইয়া গেল।
অভাব অভিযোগের ইয়ত্তা ছিল না, শরীরও ভাঙিয়া গিয়াছিল। সৈয়দ সাহেব শীঘ্রই নিতান্ত অসুস্থ হইয়া পড়িলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর ডাক পড়িল। তিনি জান্নাতবাসী হইলেন।
.
৩৮.
তখনকার দিনে ডিপুটিগিরি চাকরি সুপারিশের ওপর নির্ভর করিত। সুপারিশ যোগাড় করিতে হইলে বিস্তর টাকা-পয়সা খরচ হইত। যার টাকা-পয়সার অভাব সে যথেষ্ট কৃতবিদ্য হইলেও চাকরি তার জুটিত না। আলতাফের ওকালতি ব্যবসায় পছন্দ না হওয়ায় শেষে বাদশা মিঞার ইচ্ছানুসারে ডিপুটিগিরির চেষ্টার কথা মীর সাহেবের নিকট উপস্থিত করিল। মীর সাহেবের শরীর দিন দিন ভাঙিয়া পড়িতেছিল। আলতাফের ওকালতি ব্যবসায় ভালো লাগে না। সুতরাং মীর সাহেব কোনো আপত্তি করিলেন না এবং যথাসাধ্য সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। বাদশা মিঞাও অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া লালমিঞার দ্বারা মালেকার সহিত আলতাফের বিবাহের প্রস্তাব রিয়া পাঠাইলেন। লালমিঞা আলতাফকে ডিপুটি করার কথা পাকা করিয়া লইলেন। মীর সাহেব যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া দেখিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং কয়েকদিন পরেই আলতাফকে সঙ্গে লইয়া সদরে গিয়া পৌঁছিলেন।
সদরে গিয়া প্রথমে তিনি হরনাথবাবুর সহিত দেখা করিলেন। হরনাথবাবু সদরেই ওকালতি করিতেছিলেন এবং সেখানে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বেশ অর্জন করিয়াছিলেন। যেমন স্বাস্থ্য তেমনি মেজাজ। লেখাপড়ায় যেমন, আইনের জ্ঞান ততোধিক। এদিকে টেনিস খেলায় তিনি সদরের চ্যাম্পিয়নরূপে পরিগণিত। জজ সাহেব, পুলিশ সাহেব ও কালেক্টর সাহেব প্রায় প্রতিদিন তাহার সহিত খেলা করেন। কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে খেলার সূত্রে তার সহিত বেশ একটু ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়া উঠিয়াছিল। মীর সাহেব এ সমস্ত খবর জানিয়াই হরনাথবাবুর নিকট গিয়া সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলেন। হরনাথবাবু প্রথমটা বলিলেন, তা ওকালতিই তো ভালো। এখানে Scope বড় বেশি; আর আজকাল, ডিপুটিগিরি পাওয়াটা লটারি বৈ আর কিছু নয়। উনি এখন ওকালতি করছেন, চাকরির চেষ্টা করতে গেলে এখানে ওখানে দৌড়-ঝাঁপ করে বেড়াতে হবেখন; মক্কেল দু-চারটা যা আছে তারা সব বেহাত হয়ে যাবে। শেষে ধরুন। যদি চাকরি নাই মিলল, তবে তো সেই আবার কেঁচে গণ্ডুষ। আলতাফ একটুখানি বিনয়ের হাসি হাসিয়া কহিল, আমার মক্কেল আদৌ নাই, যা ২/১ জন কখনো কখনো আসে তারা। পরামর্শ নিয়ে শেষকালটা ভেঙ্গে পড়ে। দুই-এক জন এমনও আছে যে কাগজপত্র সব রেখে। গেল, বলে গেল নিশ্চয়ই আমাকে উকিল দেবে; কিন্তু পরদিন অথবা এমনকি দিনের দিন বললে আমি নূতন উকিল বলে ভরসা হয় না। এমন করে আর কী করে চলে! বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। বাড়িতে বৃদ্ধ পিতাও আমি একটু সাহায্য করব বলে অনেকদিন আশা করে রয়েছেন, এখন ওকালতিতে যা দেখছি তাতে আমার আর কোনো ভরসা হচ্ছে না।