সংবাদ পাইয়া আবদুল্লাহ্ কয়েকদিনের casual leave লইয়া আবদুল কাদেরকে দেখিতে আসিল। আবদুল কাদের আর সে আবদুল কাদের নাই। একেবারে অস্থিচর্মসার, তাহার কঙ্কালের প্রতি তাকাইয়া আবদুল্লাহর চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। আবদুল কাদেরের কাঁদিবার শক্তি ছিল না, দুই হাত বাড়াইয়া ইশারা করিয়া তাহাকে বসাইয়া দিতে বলিল। অতি সন্তর্পণে সকলে মিলি ধরিয়া তাহাকে পিছনে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়া বসাইয়া দিল। তাহার চক্ষু ছলছল করিতেছিল। আবদুল্লাহকে কাছে ডাকাইয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, ভাই, গোনা-খাতা মাফ্ কর। তাহার পর হালিমাকে দেখাইয়া অস্পষ্টস্বরে কী একটা কথা বলিল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার ণণ্ড বাহিয়া দুই ফোট তপ্ত অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করিয়া নানারূপ আশ্বাসবাণী দিয়া আবদুল কাদেরকে সান্ত্বনা দিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিল। আবদুল কাদের আর বসিতে পারিতেছিল না। সকলে মিলিয়া অতি সন্তর্পণে তাহাকে শোয়াইয়া দিল ।
একবালপুরে সংবাদ পৌঁছিল। সৈয়দ সাহেব বলিলেন, আর কী হবে–আমার ওসব জানাই আছে। সবই খোদার মরজি, নইলে এমন হবে কেন?
আবদুল মালেক কহিল, তা আব্বাজান, ধরুনগে আপনার আবদুল কাদের তো ছেলেমানুষ, আপনি ওকে মাফ করে দিন; আর আমি না হয় একবার ওকে দেখে আসি।
সৈয়দ সাহেবেরও শারীরিক অবস্থা দিন দিন কাহিল হইয়া আসিতেছিল। নিজের যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ বাবা, আমিও তাই মনে করছি, তুমি গিয়ে দেখে এস। আমার নড়াচড়ার হাঙ্গামা সইবে না।
অবশেষে সৈয়দ সাহেবের আদেশমতো আবদুল মালেক মজিলপুর আসিয়া উপস্থিত হইল। আবদুল মালেক আসিয়া যাহা দেখিল তাহাতে সে একেবারে বসিয়া পড়িল। সে আবদুল্লাহকে কহিল, তা দুলাহ্ মিঞা, ধরগে’ তোমার বরিহাটীতে নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না? হালিমার ব্যারাম তো ধরগে’ তোমার ওই বরিহাটীর ডাক্তার বাবুই ধরগে’ তোমার আরাম করে দিয়েছিলেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, কী আর নিয়ে যাব! দেখছেন তো হাড় কখানা। ও নিয়ে যেতে গেলে পথেই গুড়া হয়ে যাবে। নেবার মতো অবস্থা থাকলে কি আর বসে আছি! কিছুই নেই। এখন যে আর। কোনো আশাই নেই ভাইজান–বলিয়া আবদুল্লাহর চক্ষু দিয়া অশ্রু বাহির হইল। ঠিক সেই সময়েই হালিমার উচ্চ ক্রন্দন-রোল উভয়ের চমক ভাঙাইয়া দিল, উভয়ে ব্যতিব্যস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া কলেমা পড়িতে লাগিল। হালিমার হাত-পা তখন থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। আবদুল্লাহ্ তাহাকে একপাশে সরাইয়া তাহার হাত হইতে চামচটি লইয়া একবার মুখে পানি দিল।
হালিমা কহিল, ভাইজান আর পানি দেবেন না। আবদুল মালেক কলেমা পড়িতে পড়িতে পা দুটি সোজা করিয়া দিল। সকলেই সমস্বরে পড়িতে লাগিল, লা-এলাহা-ইল্লাল্লাহ্ মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্।
যথাসময়ে কাফন-দাফন সমাধা করিয়া, লাখ কলেমা পড়াইয়া এবং কয়েকজন ফকির-মিসকিনকে খাওয়াইয়া হালিমা ও তাহার সন্তান কয়েকটিকে লইয়া আবদুল্লাহ্ ও আবদুল মালেক একবালপুরে ফিরিয়া আসিল। আসার সময় ফজলু মিঞা হালিমাকে কয়েকদিন তাহাদের বাড়ি রাখিয়া পরে একটু সুস্থ হইলে লইয়া গেলে হইবে এইরূপ পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার স্বামীর অসুস্থ অবস্থায় যে ফজলু মিঞা একদিনও দেখিতে আসিলেন না, তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে হালিমা আদৌ রাজি হইল না। হালিমা আরো জানিত যে, ফজলু মিঞা তাঁর দীনী এলেমের প্রতি উৎকট নেশায় বশীভূত থাকায় আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে নানারূপ সমালোচনা করিয়াছে এবং তদ্দরুন আবদুল কাদেরকে অনেক যন্ত্রণাও পোহাইতে হইয়াছে। মাদ্রাসায় কতকগুলি ছেলেকে ইংরেজি, বাংলা ও অঙ্ক শিখাইতে চেষ্টা করায় ফজলু মিঞা আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে একবার কাফেরের ফতোয়ার কথাও ভাবিয়াছিলেন। সে বাড়িতে হালিমা কিছুতেই যাইতে রাজি হয় নাই।
বিধবার বেশে হালিমা যখন রসুলপুরে পৌঁছিল, তখন তাকে দেখিয়া তাহার মা একেবারে উন্মাদের ন্যায় কাঁদিয়াউঠিলেন। আবদুল্লাহ্ অশ্রুসজলচক্ষে মাকে শান্ত করিবার জন্য বলিল, সবর করুন আম্মা, সবর করুন! ওতে গোনাহ্ হয় আম্মা, তা তো জানেন। পরে আবদুল কাদেরের বড় ছেলেটিকে তাহার মায়ের কোলে দিয়া বলিল, দোয়া করুন। এরা বেঁচে থাকুক, মানুষ হোক।–কে কার কথা শোনে, ছেলেটিকে ধরিয়া মা ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। হালিমা কাদিতে দিতে অশ্রু নিঃশেষ করিয়া ফেলিয়াছিল। সে আর কাঁদিতে পারিল না। তাহার কোলের ছেলেটি ক্ষুধায় অস্থির হইয়াছিল। আবদুল্লাহ্ মাকে বলিল, আম্মা, দুধ থাকে তো ওকে একটু দুধ দিন। যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করিয়া শিশুটিকে কোলে লইয়া তাহাকে দুধ খাওয়াইবার জন্য জননী উঠিয়া গেলেন।
আবদুল্লাহ্ হালিমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল যে আবদুল কাদেরের life insure-এর দরুন ৫০০০ টাকা পাওয়া যাইবে। এই টাকা দ্বারা ছেলেগুলো হয়তো ভবিষ্যতে মানুষ হইতে পারে এই ভরসা দিয়া সে হালিমাকে অনেকখানি আশ্বস্ত করিয়া ছুটিশেষে রসুলপুর রওয়ানা হইল।
আবদুল কাদের যে life insure করিয়াছিল, এ কথা সকলেই জানিত। এখন অনটনের মধ্যে পড়িয়া সেই টাকাগুলির ন্যায্য অংশ হস্তগত করিবার জন্য সৈয়দ সাহেব উপায় উদ্ভাবন করিতে লাগিলেন, দুই-এক জনকে ডাকাইয়া সলাপরামর্শও করিলেন। শেষে স্থির করিলেন আবদুল্লাহর দ্বারাই টাকাটা উঠাইয়া লইতে হইবে, কারণ সে ভিন্ন হালিমাকে রাজি করা সম্ভব হইবে না এবং এত হাঙ্গামা হুজ্জৎ অন্য কেহও পোহাইতে পারিবেন না।