সেদিন লালমিঞা আসরের নামায বাদ খড়ম পায়েই আসিয়া বাদশা মিঞার বাটী উপস্থিত। যথারীতি সালাম-সম্ভাষণ বাদ বাদশা মিঞা বলিলেন, মীরের পো এবার সৈয়দ সাহেবের বাড়িতে যে দাওৎ খেয়ে এল। আজকাল আর বাছ-বিচার কিছুই রইল না।
লালমিঞা, যা বলেছেন, সব একাকার হয়ে গেল। লোকটা বড় ফন্দিই জানে। কি জানেন, সহজে কি সৈয়দ সাহেবের বাড়ি দাওৎ পেয়েছেন! নগদ ১০০০০ টাকা ঘুষ।
১০০০০ টাকা ঘুষ! এ্যাঁ, বলেন কী?
তা বুঝি জানেন না। কত তালেই যে উনি আছেন! ছাপোষা মানুষ যদি হত তা হলে আর এতটা হত না। ওই যে আবদুল্লাহর দেনমোহরের টাকা; টাকাটা তো উনিই দিলেন কিনা? না হলে আবদুল্লাহ অত টাকা কোথায় পেত?
এ্যাঁ, দশ দশ হাজার টাকা দিলে? এত টাকা? হ্যাঁ, তা আর কি? পরের টাকা পরেই খাবে। আবদুল্লাহ্ কি আর কখনো ওই টাকা শোধ দিতে পারবে! ও যেমন এসেছে তেমনই যাবে সে কথা মীরের পো বেশ ভালোই জানে। মাঝখান থেকে সৈয়দের বাড়ি দাওৎ খেয়ে এই যে সমাজে একটু আটকা-আটুকি ছিল সেইটে খসিয়ে নিল। এখন তো মীরের পোর পোয়াবারো। আরো টাকার জোরে সব কতকগুলি ছেলেকে এমন হাত করেছে, এই দেখুন না আমার আলতাফ। সে তো আমার কোনো তওয়াক্কাই রাখে না। আর ও লোকটা এমন জাদু জানে! ওই যে একটা বিধবা মেয়ে মালেকাকে জুটিয়েছে। ছেলেটাকে এমনি সলাহ পরামর্শ দিয়েছে যে সে বলে যে ওই মালেকা না হলে সে আর বিয়েই করবে না। কী সব বেহায়াপনা দেখুন না। ছেলে নিজমুখে বলে কিনা সে ওখানে ছাড়া আর কোথাও বে করবে না।
লালমিঞা বলিলেন, শুনেছি মালেকা নাকি তার স্বামীর জীবনবীমার দরুন ৫০০০ টাকা পেয়েছে।
টাকার কথায় বাদশা মিঞা একটু নরম হইয়া কহিলেন, হ্যাঁ, সেও একটা কথা। আবার শুনেছি যে মীর সাহেব নাকি আরো ৫০০০ টাকা তাকে দান করেছেন। তা একত্রে দশ হাজার টাকা একটা মোটা টাকা বৈকি!
লালমিঞা বলিলেন, তা তো বটে, মেয়েটা কিন্তু বিধবা।
তা ছেলে নাকি বলে, বিধবা হলে কী হয়, আমরা তো আর হিন্দু নই। আমাদের বিধবা-বিবাহে তো কোনো আপত্তি নেই।
লালমিঞা, তা তো বটে, তবে কিনা একটা খুঁত।
সমাজে একটু নিন্দার কথা তো বটেই। মেয়েটি নাকি বেশ সুন্দরী। আর দেখুন না, টাকারও কিছু দরকার হয়ে পড়েছে। ছোকরাকে তখন বললাম ল পড়ে কাজ নেই, ডিপুটিগিরির চেষ্টা কর, কিছুতেই:শুনলে না; এখন বুঝ। ওকালতি তার আর ভালো লাগছে না। পয়সা-কড়ি বিশেষ কিছু পাচ্ছে বলে মনে হয় না। তা আমি আর কী করি! মীরের পোর পরামর্শ বিনে তো কোনো কাজেই সে হাত দেবে না। যাক, একবার মীরের পোর সঙ্গে পরামর্শ করেই দেখা যাক। দেখি কী বলে।
৩৬-৪১. মজিলপুরে বদলি
মজিলপুরে বদলি হইয়া আসার পর আবদুল কাদের আয় বাড়াইয়াছিল কিন্তু রসুলপুর ও মাদারগঞ্জের বন্ধকের দরুন মাসিক ৬০ টাকা পরিশোধ করিয়া যে টাকা অবশিষ্ট থাকিত। তাহাতে সংসার চালানো বেশ কঠিন। কয়েকটি ছেলেমেয়ে লইয়া আবদুল কাদের খুব কষ্ট করিয়া যথাসাধ্য মিতব্যয়ীভাবে সংসার চালাইয়া আসিতেছিল। কিন্তু আপিসের খাটুনি খাঁটিয়া এবং সাধারণের উপকারের জন্য নানারূপভাবে তাহাকে পরিশ্রম করিতে হয়। যেমন খাটুনি তেমন আহার জোটে না। পিতৃঋণ পরিশোধ না করিলেও চলে না। তা ছাড়া মাঝে মাঝে গরিব দুই-এক জন আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করিতেও হয়। একশত বা শওয়া শত টাকার মধ্যে ৬০ টাকা গেলে আর কতই-বা থাকে! হালিমা দেখিল আবদুল কাদেরের শরীর দিন দিন খারাপ হইয়া চলিয়াছে। অন্যান্য নাশতা যোগাড় করা দুঃসাধ্য, তাই হালিমা তাহাকে সকাল-বিকাল একটু দুধ খাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলে আবদুল কাদের বলিত, ছেলেমেয়েদেরই দুধ জুটাতে পারি না আর আমি বুড়ো মানুষ দুধ খাব!
এইভাবে দিন কাটিতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আবদুল কাদেরের স্বাস্থ্যও অসম্ভবরূপে ভাঙিয়া পড়িতেছিল। মাঝে মাঝে জ্বর হইতে লাগিল; কুইনাইন খাইয়া জ্বর বন্ধ করা হয়, কিন্তু জ্বরটা কী জ্বর এবং তার ঔষধ কী এ সম্বন্ধে প্রথমটা কেহই মাথা ঘামাইল না। যাহাদের অর্থের অভাব তাহাদের দেহদুর্গের মধ্যে কোনো শত্রু প্রবেশ করিলেও তাহাদের বিশেষ হুঁশ হয় না। অবশেষে এমন হইয়া আসিল যে, জ্বর আর ছাড়ে না। তখন ডাক্তারের ডাক পড়িল। মজিলপুরে যে ডাক্তার ছিল, সে পরামর্শ দিল রক্ত পরীক্ষা করিতে হইবে। তদনুসারে বরিহাটী রক্ত পাঠানো হইল। পরীক্ষা করিয়া জানা গেল রক্তের মধ্যে কালজ্বরের বীজাণু ঢুকিয়াছে। আবদুল কাদের মনে মনে হতাশ হইয়া পড়িল; কিন্তু উপায় নাই। হালিমা ব্যাকুল হইয়া উঠিল। সকলে পরামর্শ দিল বরিহাটী গিয়া চিকিৎসা করা দরকার। আবদুল কাদের মনে মনে টাকার অভাব অনুভব করিল। পিতা বিমুখ; আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমন কে-ই বা । আছে যে টাকা দিয়া সাহায্য করিবে! কিছু টাকা কর্জ করিতে পারিলে চিকিৎসার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা এখন যেরূপ তাহাতে কে-ই বা কর্জ দেয়!
মানসিক উদ্বেগ ও অশান্তির মধ্যে অসুস্থদেহে কয়েকদিন আপিসের কাজ চলিল বটে কিন্তু তাহা আর বেশিদিন চলিল না। অবশেষে যখন আবদুল কাদের একেবারে শয্যাগ্রহণ করিতে বাধ্য হইল তখন ছুটির দরখাস্ত করা হইল।
কিস্তির টাকা দেওয়া হইবে না, হালিমার কী উপায় হইবে, ছেলেমেয়েদের কী দশা। হইবে; পিতার যেরূপ মতিগতি তাতে পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে তাও রক্ষা হইবে না। আর যদিই-বা রক্ষা হয় তাহা ভাগ হইয়া গেলে থাকিবেই-বা কী ইত্যাদি দুশ্চিন্তা আবদুল কাদেরকে একেবারে অধীর করিয়া ফেলিল।