এই পত্রের উত্তরে আবদুল্লাহ সবিনয়ে জানাইল যে, একসঙ্গে অত টাকা দেওয়া তার সাধ্যাতীত কিন্তু সে কিস্তি করিয়া টাকা পরিশোধ করিতে সম্মত। প্রত্যুত্তরে সৈয়দ সাহেব জানাইলেন যে, তার এত টানাটানি যে তা বলিবার নয়; টাকার বড় দরকার। সুতরাং তিনি বিলম্ব করিতে অক্ষম।
অগত্যা আবদুল্লাহ্ তাহার পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দিয়া টাকা পরিশোধের কথা ভাবিতে লাগিল! কিন্তু সম্পত্তি কী আর ছিল! দেখা গেল যে বন্ধক কেন, বিক্রি করিলেও সে অত টাকা সংগ্রহ করিতে অক্ষম। আবদুল্লাহ বড়ই বিচলিত হইয়া পড়িল।
চাকরি করিয়া আবদুল্লাহ্ মোট ১০০০ টাকা জমাইয়াছিল। অনেক চিন্তার পর সেই টাকা এবং সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক দিয়া আরো ৮০০ টাকা সগ্রহ করিয়া একত্রে ১৮০০ টাকা সে সৈয়দ সাহেবকে পাঠাইয়া দিল। কিন্তু ইহাতে সৈয়দ সাহেব একটুও সন্তুষ্ট হইলেন না।
মীর সাহেব ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলেন। মাঘ মাসের পূর্বে বাড়ি ফিরিবেন না। আবদুল্লাহ্ বড়ই চিন্তায় দিন কাটাইতে লাগিল। যাহা হউক মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহেই মীর সাহেব বাড়ি ফিরিলেন এবং সমস্ত সংবাদ জানিয়া অগত্যা তিনিই আবশ্যক টাকা কর্জ দিতে চাহিলেন। আবদুল্লাহ্ অগত্যা তাহাতেই স্বীকৃত হইল এবং বিনা দলিলে ১০০০০ টাকা কর্জ করিয়া স্বয়ং একবালপুরে গিয়া সৈয়দ সাহেবের হস্তে দিয়া আসিল। সৈয়দ সাহেব তখনই একখানা রসিদ লিখিয়া দিলেন। আবদুল্লাহ মীর সাহেবের নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে এ-কথা সৈয়দ সাহেব অবগত ছিলেন। সুদের টাকা লওয়া জায়েজ কিংবা না জায়েজ এ সম্বন্ধে তর্ক উঠিতে পারে এবং সৈয়দ সাহেব উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া জানিয়াছিলেন যে ২৫০০০ টাকা দেওয়া আবদুল্লাহর পক্ষে একেবারে অসম্ভব, সুতরাং আদালত। হয়তো অত টাকা ডিক্রি দিবে না। এতদ্ভিন্ন সংসারে আজকাল টানাটানি একটু বেশিই হইয়াছে। সৈয়দ সাহেব যা টাকা পাইলেন তাহাতেই রাজি হইয়া সম্পূর্ণ টাকার রসিদ লিখিয়া দিলেন। টাকা প্রাপ্তির পর সৈয়দ সাহেব আবদুল মালেককে ডাকিয়া আনিয়া বলিলেন, তোমার ওই ছেলেটার খানার কথাই ভাবছি। আবদুল্লাহর নিকট যে টাকাটা পাওয়া গেছে তার কিছুটা হাত-কর্জ শোধ দিতে যাবে। আর কিছু টাকা দিয়ে খাৎনার খরচটা চলে যাবে!
আবদুল মালেক মনে মনে ভাবিয়াছিল ওই টাকাটা দিয়া রসুলপুর ও মাদারগঞ্জের তালুকটার–যা ভোলানাথবাবুর নিকট বন্ধক ছিল, সেটা খালাস করিয়া লওয়া যাইবে। সে বলিল, তা আব্বাজান ধরুনগে আপনার ওই তালুক দুটো খালাস করে নেওয়া তো দরকার।
সৈয়দ সাহেব বলিলেন, বাবা, আমি আর কদ্দিন যে কদিন আছি খোদা এদের দেছেন, এদের নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করে যাই, তোমরা তো রইলে।
আবদুল মালেকের পুত্রের খান্নার দিন স্থির হইয়া গেল। খাত্না উপলক্ষে সৈয়দ সাহেব কিছু ধুমধামই করিয়া বসিলেন। তার শারীরিক অবস্থা আজকাল ভালো ছিল না। এই হয়তো তার জীবনের শেষ কাজ। সুতরাং যাতে বংশমর্যাদা বজায় থাকে এরূপভাবে লোকজনকে খাওয়াইবার ভাগ্য হয়তো তার আর জুটিবে না মনে করিয়া কয়েক গ্রামের লোককেও দাওয়াদ দিলেন এবং আত্মীয়-বন্ধু যে যেখানে ছিল সবাইকে দাওয়াদ দেওয়া হইল। বরিহাটী হইতে সওদা আনা হইল। বাবুর্চি খানসামা বাড়িতে যারা ছিল তাদের দ্বারাই পাকের বন্দোবস্ত হইল। নির্দিষ্ট দিনে বহু লোক তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করিয়া বলিল এমন খানা তারা জীবনে কখনো খায়ও নাই, খাইবেও না। অবশ্য ঠিক এই ভাবের কথা তারা এই সৈয়দ সাহেবের বাড়িতে আরো বহুবার বলিয়াছে। সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া ভোলানাথবাবু। বলিলেন, হবে না কেন? সৈয়দদের মতো বড় বংশ তো আর এ অঞ্চলে নাই। এঁরাই তো। এককালে নবাব ছিলেন।
এই উপলক্ষে আত্মীয়-বন্ধুদের সওয়ারিও আনা হইয়াছিল, সুতরাং ধুমধামের জের আরো দশ-পনের দিন চলিল। আরো কিছুদিন হয়তো চলিত–কিন্তু দেখা গেল যে টাকাগুলা কেমন করিয়া ফুরাইয়া গিয়াছে। এতগুলা টাকা কেমন করিয়া যে গেল তার হিসাবই পাওয়া গেল না। সৈয়দ সাহেব কিন্তু বলিলেন, তা বৈকি–কতই আর টাকা!
.
৩৫.
মীর সাহেবের সাহায্যে আলতাফ যথাসময়ে বি-এ ও ল পাস করিয়া বরিহাটীতে ওকালতি করিতেছে। বাদশা মিঞা এখন আলতাফের বিবাহ সম্বন্ধে বেশ একটু উৎসুক হইয়া পড়িয়াছেন। এদিকে আলতাফের মালেকার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সংবাদে বাদশা মিঞা চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। কৃতবিদ্য ছেলের পিতা হওয়া যেমন গৌরবের তেমন দায়িত্বপূর্ণও বটে। যদিও মুসলমান সমাজের নিয়মানুসারে বিবাহের ভার বহন সাধারণভাবে ছেলের পক্ষেই করিতে হয় তথাপি শিক্ষিত ছেলের সংখ্যা কম। মেয়েকে সৎপাত্রে দান হিন্দু সমাজের পক্ষে জটিল বটে কিন্তু মুসলমান সমাজে উহা জটিলতর। শরীফ খানদানের সঙ্গে সম্বন্ধ করিতে হইবে; কিন্তু সাধারণত পুরোনো ঘরানাদের অবস্থা আজকাল প্রায়ই সচ্ছল নয়। লেখাপড়া শিখিয়া যাহারা চাকরি বা ওকালতি বা ওইরূপ কোনো স্বাধীন ব্যবসায়ের। দ্বারা নিজের স্ত্রী-পরিবার প্রতিপালন করিতে সক্ষম তাহাদেরও সংখ্যা কম। সুতরাং বি-এল পাস ছেলের আদর যথেষ্ট। বাদশা মিঞা মনে বহু আশা পোষণ করিতেছিলেন। কিন্তু মীর সাহেবের প্রতি ছেলের অত্যধিক ভক্তির পরিচয় পাইয়া তিনি অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন। তথাপি পিতার কর্তব্যপালনে তিনি কিছুতেই পরাঙ্মুখ হইবেন না।