আবদুল কাদের বিনয়-নম্র বচনে আরজ করিল, হুজুর, লোগ সব গোরাহ্ হোতে চলা হায়। আওর জারা-সা হেসাব না জানে সে মহাজন আওর জমিনদার লোক গরিবো পর বড়া জুলুম করতে হয়। লোগ্ সব্ ভুকা মর্ রহে হ্যাঁয়। এনলোগঁ কী জেন্দেগীকে ওয়াস্তে কুছ্ আংরেজী আওর বাংলা আওর হেসাব জানা জরুরি হায়।
পীর সাহেব ঊর্ধ্বে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক কহিলেন, দীন ইসলাম কো আগে বাঁচানা চাহিয়ে। জেন্দেগীকে ওয়াস্তে খোদাও করিম পর তওয়াল করনা ওয়াজেব হায়! রাজ্জাক কো ভুলকে রোজীকা বন্দোবস্ত হো নেহী সান্তা। খায়ের, ইয়ে সব তার সে কুছ হী ফায়দা নেহী নেক্লেগা।
আবদুল কাদের রণে ভঙ্গ দিয়া পীর সাহেবের কদমবুসি সম্পন্ন করিয়া বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। পীর সাহেব বড়ই নারাজ হইয়া বজরায় চলিয়া গেলেন এবং পরদিনই মজিলপুর গ্রাম পরিত্যাগপূর্বক চলিয়া গেলেন।
পীর সাহেব চলিয়া যাওয়ার পর আবদুল কাদের একটি মিল মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য চেষ্টা করিয়াছিল। চারিদিকে ঘোর আপত্তি হওয়ায় অবশেষে মাদ্রাসার জনকতক ছাত্রকে নিয়া একটু একটু ইংরেজি শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত করিতে সক্ষম হইয়া নিজেকে ধন্য মনে করিল।
.
৩৩.
নৌকা চলে না, রেলগাড়িতে চলাফেরায় বেপরদা–এই অজুহাতেই আবদুল্লাহর শ্বশুর সালেহাকে রসুলপুরে পাঠান নাই। গ্রীষ্মের বন্ধেও নৌকা চলিবে না। কাজেই তখনো তিনি সেই অজুহাত ধরিয়া বসিবেন। অতএব আবদুল্লাহ্ স্থির করিয়া লইল গ্রীষ্মের বন্ধে একবার শ্বশুরবাড়ি যাইয়া দেখাশুনা করিয়া আসিবে। তাহার পর পূজার বন্ধে নৌকা চলাচল আরম্ভ হইলে সালেহাকে লইয়া আসিবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার্যত তাহা ঘটিয়া উঠিল না। কারণ স্কুলের লাইব্রেরির পুস্তকগুলি বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল, সেগুলিকে শৃঙ্খলামতো সাজাইতে গিয়া গ্রীষ্মের বন্ধে তাহার পক্ষে আর রসুলপুর ত্যাগ করা ঘটিয়া উঠিল না।
দিনের পর দিন কাটিতে লাগিল। পূজার বন্ধও ঘনাইয়া আসিল। এযাবৎ একবালপুরের কোনো খবর না পাওয়ায় আবদুল্লাহর মন কেমন একটি অজানা আশঙ্কায় অস্থির ও চঞ্চল হইয়া উঠিল। চিঠিপত্র লিখিয়া উত্তর পাওয়াও সহজ ব্যাপার নয়। কারণ ও-বাড়িতে এক আবদুল কাদের ভিন্ন প্রায় সকলেই দোয়াতে কলম দান ব্যাপারটাকে গর্হিত মনে না করিলেও সহজ মনে করিতে শেখে নাই। প্রায় ৬ মাস পরে ভাদ্রমাসের ৪ঠা তারিখে একখানা পত্র আসিল। কালো কালির লেখা দুঃসংবাদ আবদুল্লাহর হৃদয়ে কালো দাগ আঁকিয়া দিল। আসন্নপ্রসবা সালেহার আসন্ন মৃত্যুর সংবাদে আবদুল্লাহর হৃদয়ে শেল বিধিল।
আহার ও নিদ্রা ত্যাগ করিয়া, গরুর গাড়ির কঁকানি সহ্য করিয়া, কাদা ও বৃষ্টি তুচ্ছ করিয়া, আকাশের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করিয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া জুতা হাতে নগ্নপদে আবদুল্লাহ্ যখন একবালপুরে পৌঁছিল তখন সব শেষ হইয়া গিয়াছে। সাদা লংক্লথে মোড়া খট্টাশায়ী কাষ্ঠখণ্ডবৎ দেহখানির মস্তকাবরণ উঠাইয়া তাহাকে দেখানো হইল। সেই মুখ–কিন্তু কী পরিবর্তন! শীর্ণ পাণ্ডুর রক্তলেশ পরিশূন্য, আঁখিপল্লব নিমীলিত, ঈষদুদ্ভিন্ন অধরোষ্ঠ–কী যেন বলিতে চায়, অথচ বলিতে পারে না। আবদুল্লাহর মমতলে মৃত্যুশেল বিধিল। তাহার মুখে কথা ফুটিল না। কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে বুক-ফাটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। তাহার পর ধীরে ধীরে দাফন-ক্ষেত্রের দিকে চলিয়া গেল।
.
৩৪.
ভগ্নহৃদয় লইয়া আবদুল্লাহ্ কর্মস্থলে ফিরিল। মীর সাহেব আদ্যোপান্ত সকল সংবাদই শুনিলেন। আবদুল্লাহর মনে একটা যে বৈরাগ্যের ভাব জাগিয়া উঠিয়াছে; তাহা তিনি সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু সে-ভাবকে আদৌ তিনি প্রশ্রয় দিলেন না। নানা প্রকারে সান্ত্বনা দিয়া তিনি আবদুল্লাহকে পুনরায় কর্মক্ষেত্রের মাঝে টানিয়া আনিলেন।
আবদুল্লাহ্ মীর সাহেবের আদেশ-অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারিল না। সে আবার যথারীতি স্কুলের কার্যে মনঃসংযোগ করিল। এই সময়ে হঠাৎ একদিন একবালপুর হইতে সৈয়দ সাহেবের এক পত্র আসিয়া পৌঁছিল। পত্রে সৈয়দ সাহেব মোহরানার দাবি করিয়াছেন।
আবদুল্লাহর পিতা ওলিউল্লাহর সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে সৈয়দ সাহেব নারাজই ছিলেন। শুধু মাতার অনুরোধেই তিনি সম্মত হইয়াছিলেন। এদিকে সৈয়দ সাহেব যখন ২৫০০০ টাকা মোহরানা দাবি করিয়া বসিলেন, বড় ঘরে বিবাহ দিবার আগ্রহে আবদুল্লাহর পিতা রাজি হইয়া গেলেন। আবদুল্লাহও তখন এ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিতে পারে নাই। কারণ সাধারণত এই মোহরানা একটা অর্থশূন্য প্রথা বলিয়া বিবেচিত হয় এবং বাস্তবিকপক্ষেই যদি সৈয়দ সাহেবের অবস্থার পরিবর্তন না হইত তবে এ সম্বন্ধে তারাও যে কোনো দাবি করিতেন এরূপ মনের ভাব বোধহয় সৈয়দ সাহেবেরও ছিল না। কিন্তু নানা কারণেই সৈয়দ সাহেবের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হইয়াছিল। এমন অবস্থায় হকের দাবি ছাড়িয়া দিবেন এমন অবিবেচক বলিয়া সৈয়দ সাহেবকে দোষারোপ করা চলে না।
পিতার বর্তমানে কন্যার মৃত্যু হইয়াছে সুতরাং সম্পত্তির কোনো ভাগ কন্যাতে বর্তায় নাই। এমন অবস্থায় মোহরানার টাকার দাবি ন্যায্য দাবি। কন্যার অবর্তমানে জামাতা যে শ্বশুরকে ঠকাইবার চেষ্টা করিতে পারে এ ভয়ও সৈয়দ সাহেবের ছিল; তাই তিনি চিঠিতে জানাইয়াছিলেন যে সহজে টাকা না দিলে আদালতে নালিশ করা হইবে; তিনি হক্কের দাবি ছাড়িয়া দিতে কিছুতেই পারিবেন না। তিনি আরো লিখিয়াছিলেন যে, যদি আদালতে নালিশ করেন তবে ডিক্রি নিশ্চয়ই হইবে এবং আবদুল্লাহর মোকদ্দমা খরচ বাবদ কিছু টাকা অনর্থক দণ্ড দিতে হইবে।