পীর সাহেবের প্রতি ফজলুর ভক্তি অচল। পীর সাহেবের আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইয়া ফজলু যখন সত্য সত্যই এই বিবাহের জন্য বাপ-মায়ের অনুমতি লইয়া আসিল, তখন বিবাহে আর কোনো বাধাই রহিল না। যথাসময়ে শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। ফজলু মিয়ার এখন আর্থিক কোনো কষ্টই রহিল না। পীর সাহেবের মেহেরবানিতে খাওয়া-পরার ভাবনা পার হইয়া ফজলু দশগুণ উৎসাহে পীরের খেদমতে নিযুক্ত হইল। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, দোয়া দরুদ, মহফেলে-মৌলুদ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কোনো ত্রুটি নাই। যাকাতের হিসাবের জন্য একজন মুহুরিই নিযুক্ত হইয়া গেল। এসব বিষয়ে কোনো দিকে ত্রুটি রহিল না বটে কিন্তু আদায়পত্র ইত্যাদি সমস্তই কর্মচারীদের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হইল।
কয়েক মাস পরের কথা। পিতৃবিয়োগের সংবাদ পাইয়া ফজলু মিঞা সস্ত্রীক পিতার ফাতেহার জন্য বাড়ি আসিয়াছে। এই উপলক্ষে পীর সাহেবকেও দাওয়াদ করা হইয়াছিল। আবদুল কাদেরকে দাওয়াদ করার জন্য যখন ফজলু মিঞা আবদুল কাদেরের বাসায় আসিয়াছিল, তখন মাদ্রাসা সম্বন্ধে তাহার সঙ্গে বহু আলাপ হইয়াছিল। আবদুল কাদের মাদ্রাসার ছাত্রদিগকে কিছু ইংরেজি, বাংলা ও অঙ্ক শিক্ষা দিবার প্রস্তাব করিলে ফজলু মিঞা একেবারে যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। সে কী কথা, তাও কি হয়! যেখানে দীনী এলেম শেখানো হয়, সেখানে এইসব দুনিয়াদারি একদম অপ্রাসঙ্গিক। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ফজলু মিঞা কহিলেন, আচ্ছা, কালই পীর সাহেব আসছেন, তার সঙ্গে একবার আলাপ। করলেই আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারবেন। ওসব খেয়াল আপনি মন থেকে দূর করে ফেলুন। এই দেখুন না হাতে হাতে। আমি একবার চাকরির জন্য মত্ত হয়ে পড়েছিলাম। অনেক সময় আমার নামায কাযা হয়েছে। এখানে দৌড়, ওখানে লাফ এইসব করে আমার যে কী সর্বনাশ হচ্ছিল, তা খোদাই জানেন। কিন্তু পীর সাহেবের শরণাপন্ন হয়ে আমার এখন কোনো চিন্তাই নাই। খোদার কাজ কল্লে খোদা রুজি জুটিয়ে দেবেই। আমি দেখুন ইংরেজি পড়তে গিয়ে কী ভুলই করেছি! আগে থেকে যদি পীর সাহেবের শরণাগত হতাম তা হলে আমার কেসমত আরো ভালো হত। যাক এখন আসি, একবার মেহেরবানি করে গরিবখানায়। তশরীফ আনবেন। ওয়ালেদ মরহুমের কথা মনে হলে আর কিছু ভালো লাগে না। তার শেষ কাজটা যাতে সুসম্পন্ন হয় তার জন্য আপনাদের পাঁচজনের সাহায্য চাচ্ছি। আশা করি নাওম্মেদ হব না।
এই লম্বা বক্তৃতা দিয়া আবদুল কাদেরকে স্তম্ভিত করিয়া যথারীতি সালাম-সম্ভাষণপূর্বক ফজলু বিদায় গ্রহণ করিল।
পরদিন মজিলপুরে মহা ধুম পড়িয়া গেল। এক প্রকাণ্ড বজরা নদীবক্ষ বাহিয়া মৃদু মন্থরগতিতে মজিলপুরের দিকে অগ্রসর হইতে দেখা গেল। প্রায় একশত লোক ঘাটে উপস্থিত।
এহেন ভাগ্য মজিলপুরের কোনোদিন ঘটিয়াছিল কি না সে সম্বন্ধে বহুবিধ আলোচনায় বাধা জন্মাইয়া যখন ঘণ্টাখানেক পরে পীর সাহেবের বজরা ঘাটে ভিড়িল তখন সমস্বরে মাহাবা মারহাবা রবে উপস্থিত জনমণ্ডলী গগনমণ্ডল মুখরিত করিয়া তুলিল।
ফজলুর পরলোকগত পিতার ফাতেহা উপলক্ষে লক্ষ্ণৌ হইতে একজন বাবুর্চি আনা হইয়াছিল। কলিকাতা হইতে কয়েকজন মেট এবং বাবুর্চির সঙ্গেও দুই জন মেট আসিয়াছিল। আশপাশের গ্রামের মধ্যে যারা পাকপ্রণালীর সঙ্গে পরিচিত ছিল ফজলু মিঞা তাদেরও আনাইয়াছিলেন। ফাতেহার দাওয়াদ আত্মীয়স্বজন যে যেখানে ছিল সকলেই পাইয়াছিল। গরিব দুঃখী সংবাদ পাইয়া যে যেখানে ছিল আসিয়া জুটিতেছিল। ফাতেহা উপলক্ষে জেয়াফত শেষ হইয়া গেলেও পীর সাহেব যে কয়দিন মজিলপুরে ছিলেন ও অঞ্চলের বহু ভক্ত নানা কাজ ফেলিয়া পীর সাহেবের সহিত কেহ দেখা করিতে, কেহ মুরীদ হইতে, কেহ পানি পড়াইয়া লইতে, কেহ তাবিজের জন্য আসিয়া গ্রামের রাস্তাঘাট ভরিয়া ফেলিয়াছিল। এমন বিরাট আয়োজন এবং এত জনকোলাহল দেখিয়া পীর সাহেবের বুজরগী সম্বন্ধে কোনো সংশয় রহিল না।
সেদিন রাত্রে পীর সাহেবের বজরায় একটু উত্তেজনার আভাস পাইয়া কয়েকজন খাদেম একটু বিচলিত হইয়া উঠিলেন। ব্যাপার কী জানিবার জন্য উদ্গ্রীব জনমণ্ডলী এ ওর মুখের দিকে তাকাইতে আরম্ভ করিলেন। পীর সাহেব ফজলু মিঞার কয়েকজন আত্মীয়াকে মুরীদ করিবার জন্য বজরা হইতে নামিয়া পালকি করিয়া ফজলু মিঞাদের বাড়ি গিয়াছিলেন। তথা হইতে এইমাত্র ফিরিয়া আসিয়াছেন। ফজলু মিঞা অদূরে মস্তক অবনত করিয়া বসিয়া আছেন। সকলে চুপ। কিছুক্ষণ পরে পীর সাহেব একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, উওহ্ সব মিস্ত্রিয়ো কা কাম হায়, শরীফোঁ কা কাম নেহী।
ফজলু মিঞা পীর সাহেবের মন্তব্য শিরোধার্য করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, জি হ্যাঁ। হুজুর, উওহ্ সব সে আখেরাত কা ফায়দা নেহী হোগা।
ব্যাপার আর কিছুই নয়, পীর সাহেব যখন ফজলু মিঞাদের বাড়িতে গিয়াছিলেন সেই সুযোগে ফজলু মিঞার সাহায্যে আবদুল কাদের পীর সাহেবের খেদমতে হাজির হইয়াছিল। যথাবিহিত কদমবুসি সম্পন্ন করিয়া আবদুল কাদের বিনয়-নম্র বচনে পীর সাহেবের খেদমতে মাদ্রাসার সংস্কারের কথা পাড়িয়াছিল। পীর সাহেব আবদুল কাদেরের প্রস্তাবে মর্মাহত হইয়া শুধু বলিলেন, ইয়ে সব দুনিয়াদারি মামলা সে হামলোগ ফারেগ রত্না চাতে হায়। মেরা খেয়াল মে মাদ্রাসা দীনী এলেম কা ওয়াস্তে হায়। আংরেজী আওর বাংলা, আওর হেসাব ইয়ে সব তো আংরেজী স্কুল মে পড় হায়ি জাতি হায়, বাচ্চা।