আবদুল্লাহ্ মৃদুকণ্ঠে কহিল, ওদের রেলগাড়িতেই নিয়ে যাব। স্টেশন থেকে পালকির বন্দোবস্ত আছে, এতে কোনো কষ্ট হবে না। তা ছাড়া সময়ও লাগবে কম। সৈয়দ সাহেব রেলগাড়ির কথা শুনিয়া একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, তা বাবা সবই বলতে পার, কিন্তু আমাদের খানদানে কোনো জানানা কখনো এ পর্যন্ত রেলে চড়ে নি, আর আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন চড়তে দেবারও আমার ইচ্ছা নাই। সে হবে না বাবা, হাজার লোক স্টেশনে, তার মধ্যে দিয়ে রেলে চড়িয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে যাবে? এ কথা মুখে আনতেই যে আমাদের বাধে। তোমরা ইংরেজি শিখেছ, ইংরেজের চালচলন অনুকরণ করতে চাও। তা আমি আর কদিন! এই কটা দিন সবুর কর, পরে যা হয় কোরো।
আবদুল্লাহ্ বুঝিল কথা কাটাকাটিতে ফল হইবে না। সে রণে ভঙ্গ দিয়া বলিল, তা হলে হালিমাকে…।
সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, বউমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা, আবদুল কাদের মিয়া তো বাড়িই আছেন, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে যা হয় কর, আমি ওর মধ্যে নেই! সেবারে বরিহাটীর কত কী কাণ্ড-কারখানা, সে সবই তো সয়েছি।
আবদুল্লাহ কহিল, আবদুল কাদের সম্মত আছে। আপনার তো কোনো আপত্তি নাই?
সৈয়দ সাহেব, না, আমার আর কী আপত্তি! সে রাজি যখন তখন আমার আপত্তির কারণ কী?
মসজিদে আযানের সঙ্গে সৈয়দ সাহেব নামায পড়ার জন্য উঠিয়া পড়িলেন, আবদুল্লাহ্ পিছনে পিছনে নামায পড়িবার জন্য মসজিদে ঢুকিল।
নামায বাদ আবদুল্লাহ্ বাড়ির ভিতর গিয়া মাকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিল, মা একটু দুঃখিত হইলেন; কহিলেন, তবে কাল সকালেই হালিমাকে নিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত।
সৈয়দ সাহেব মসজিদের রোয়াকে বসিয়া আবদুল কাদেরকে বলিলেন, ওরা কবে যাচ্ছেন?
আবদুল কাদের, তা তো ঠিক জানি না।
সৈয়দ সাহের, তা হলে বউমাও যাচ্ছেন রসুলপুরে?
আবদুল কাদের, জি হ্যাঁ, তাই তো ওঁদের ইচ্ছা।
সৈয়দ সাহেব একটু উষ্ণভাবে বলিলেন, ওঁদের ইচ্ছা, তোমার কী? তোমারও ইচ্ছা না! এখন নৌকা চলে না জানা আছে তো, রেলে চড়িয়ে নিয়ে যাবে!
আবদুল কাদের, আমার তো কোনো আপত্তি নাই।
সৈয়দ সাহেব একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, বেশ।
কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ–একটু পরে সৈয়দ সাহেব দহলিজে চলিয়া গেলেন। আবদুল কাদের বাড়ির ভিতর আবদুল্লাহর কাছে সমস্ত বিষয় শুনিল।
পরদিন প্রত্যুষেই আবদুল্লাহ্ মাতা, ভগ্নী হালিমা এবং করিমনকে লইয়া রসুলপুর যাত্রা করিল।
.
৩২.
মজিলপুর একটি পুরাতন ও বিখ্যাত স্থান। এখানকার রেজিস্ট্রি আপিসটিও বেশ বড়। এখানে। বহু দলিল রেজিস্ট্রি হয়। যে সময়ের কথা বলা হইতেছে তখন সবুরেজিস্ট্রারগণ রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের সংখ্যা হিসাবে কমিশন পাইতেন। আবদুল কাদের বরিহাটী জয়েন্ট অফিসে বেশ যোগ্যতার সহিত কাজ করিয়া ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রারের সুনজর আকর্ষণ করিতে সক্ষম হইয়াছিল। এক্ষণে মজিলপুরে সব্রেজিস্ট্রারের পদোন্নতি হওয়ায় তিনি অন্যত্র চলিয়া গেলে আবদুল কাদের মজিলপুরে বদলি হইয়া আসিল। হালিমাও সঙ্গে আসিল। এখানে তাহার মাসিক আয়। ২৫/৩০ টাকা বাড়িয়া গেল। তা ছাড়া এখানে একটি মাদ্রাসা ছিল। একমাত্র শিক্ষার অভাবই যে সমাজের সমস্ত দুরবস্থার কারণ, ইহা আবদুল কাদের মর্মে মর্মে অনুভব করিয়াছিল। মজিলপুরে আসিয়া মাদ্রাসার সাহায্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাহার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার সুযোগ পাইবে মনে করিয়া তাহার প্রাণ হর্ষে নাচিয়া উঠিল।
আবদুল মালেকের খালাতো ভাই ফজলর রহমানের পিতা মজিলপুর মাদ্রাসার সেক্রেটারি ছিলেন। সম্প্রতি তাহার মৃত্যু হওয়ায় আবদুল কাদের মাদ্রাসার সেক্রেটারি নির্বাচিত হইল।
পীর সাহেবের দোয়া, তাবিজের বরকতে যখন ফজলু মিঞা ডিপুটিগিরির স্বপ্ন দেখিতেছিল, তখন হঠাৎ একদিন দি বেঙ্গলীতে প্রবেশনারি ডিপুটির লিস্টে ফজলু মিঞার নাম না পাইয়া ফজলু মিঞার চমক ভাঙিয়া গেল। ফজলু মিঞা দমিবার পাত্র নয়! সে ভাবিল হিন্দু কাগজওয়ালা বদমাইশি করিয়া তাহার নামটি ছাপে নাই। তারপর সে কলিকাতা গেজেটেও নাম পাওয়া গেল না। ব্যাপার কী? তবে কি পীর সাহেব দোয়া করেন নাই? না, তাও কি সম্ভব? ফজলু ছুটিয়া পীর সাহেবের খেদমতে হাজির হইল। পীর সাহেব ইতোমধ্যেই খবর পাইয়াছিলেন যে ফজলু ডিপুটি কি সব্ডিপুটি কিছুই হইতে পারে নাই। কদমবুসি সম্পন্ন করিয়া ফজলু একপাশে বিষণ্ণমনে বসিয়া পড়িল। পীর সাহেব কহিলেন, আয় লাড়কা আবৃ তক্ তু গাফেল হায়। ফজলুর হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল পীর সাহেব তাকে যে এশার নামাযের বাদ ১১০০০ বার একটি দোয়া পড়িতে বলিয়াছিলেন, কয়েকদিন যাবৎ সেটা ফজলু পড়িতে পারে নাই। তা ছাড়া অনেক দিনই ঘুম ভাঙিতে বিলম্ব হওয়ায় ফজরের নামাযও তার কাযা পড়িতে হইয়াছে। ফজলু মনে মনে পীর সাহেবকে সন্দেহ করিয়াছিল। তার দরুন তার মনে ভীষণ অনুশোচনা জন্মিল। সে উঠিয়া গিয়া আবেগভরে পীর সাহেবের পায়ের উপর পড়িল। সে মনে মনে আশা করিতেছিল পীর সাহেব ইচ্ছা করিলে তখনো তার চাকরির উপায় হইতে পারে।
পীর সাহেব মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, সব করুনা চাহিয়ে, আয় লাড়কা, এক শরীফজাদী বহুত হাসীন, আরো নেহায়েত নেখত; উত্সকে সাত তোমহারী শাদি মোবারক মায় ঠিক কিয়া। এই ওজর করনে কা মোকাম নেহি হায়। আগার পছন্দ হো তো মুঝসে ছেপানা নেহি। আলাওয়া ওকে জেমিদারি ভী খুব হায়। জেমিদারিসে দস্ বারা হাজার রুপায় কী আমদানি হয়।