মাতার অনিরুদ্ধ কণ্ঠ আবদুল্লাহকে বিচলিত করিয়া তুলিল। সে যেন মাতার আদেশ তৎক্ষণাৎ পালন করিবার জন্যে প্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী কাজ আম্মা।
মাতা কহিলেন, আমাদের এখন যেমন অবস্থা, তাতে তো আর অভিমান করে থাকলে চলবে না, বাবা! তোর শ্বশুরের কাছে গিয়ে কথাটা একবার পেড়ে দেখ, –তিনি বড়লোক, ইচ্ছে কল্লে অনায়াসে এই কটা মাস তোর পড়ার খরচটা চালিয়ে দিতে পারেন।
এই প্রস্তাবে আবদুল্লাহর মন দমিয়া গেল। সে কী উত্তর দিবে ঠিক করিতে না পারিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, পরের কাছে হাত পাততে ইচ্ছে করে না, আম্মা।
মাতা আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, পর কী রে! তার সঙ্গে যে তোর কেবল শ্বশুর-জামাই সম্পর্ক, এমত তো আর নয়।
আবদুল্লাহ্ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। মাতা আবার কহিলেন, কী বলিস?
আবদুল্লাহ্ কহিল, বলব আর কী, আম্মা; তিনি যে সাহায্য করবেন, এমন তো আমার মনে হয় না।
তিনি সাহায্য করবেন না, আগে থেকেই তুই ঠিক করে রাখলি কী করে? একবার বলেই দ্যাখ না?
আবদুল্লাহ্ কহিল, তিনি নিজের ছেলের সঙ্গে সে-বার কেমন ব্যবহার করেছিলেন, তা কি আপনি জানেন না আম্মা? আবদুল কাদের আর আমি যখন মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হই, তখন আব্বাকে আমি জানিয়েছিলাম, কিন্তু সে তার বাপের কাছে গোপন রেখেছিল। সে খুবই জানত যে, তার বাবা একবার জানতে পারলে আর কিছুতেই পড়ার খরচ দেবেন না; কেননা তিনি ইংরেজি শেখার উপর ভারি নারাজ। ফলে ঘটলও তাই; কয়েক বৎসর কথাটা গোপন ছিল, তারপর যখন আমরা ফার্স্ট ক্লাসে উঠলাম, তখন কেমন করে যেন আমার শ্বশুর সে কথা জানতে পারলেন, আর অমনি বেচারার পড়া বন্ধ করে দিলেন! আর আমি ইংরেজি পড়ি বলে আমার উপরও তিনি সেই অবধি নারাজ হয়ে আছেন। হয়তো-বা মনে করেন যে, আমিই কুপরামর্শ দিয়ে তার ছেলেকে খারাপ করে ফেলেছি।
মাতা কহিলেন, তা তিনি দীনদার পহেজগার মানুষ, তার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে আরবি পড়িয়ে মৌলবী করেন। ছেলে যখন বাপের অবাধ্য হল, আবার কথাটা এদ্দিন গোপন রাখল, তখন তো তার রাগ হবারই কথা! তুই তো আর বাপের অমতে ইংরেজি পড়তে যাস নি, তোর উপর তিনি কেন নারাজ হতে যাবেন?
আবদুল্লাহ্ কহিল, কিন্তু আমার মনে হয় আম্মা, তিনি আমাকে বড় ভালো চোখে দেখেন না। দেখুন, আব্বার ব্যারামের সময় নিজে তো কোনো খবর নিলেনই না, আবার হালিমাকে কি আপনাদের বউকে, –কাউকে পাঠালেন না…
মাতা বাধা দিয়া কহিলেন, সে তো তার দোষ নয়, বাবা! তিনি যে তখন বাড়ি ছিলেন না। তারপর যদিই-বা বাড়ি এলেন, নিজেই শয্যাগত হয়ে পড়লেন, নইলে কি আর তিনি আসতেন না!
বড় আদরের একমাত্র মেয়ে-পুত্রবধূকে স্বামী মৃত্যুকালে দেখিতে চাহিয়াও দেখিতে পান নাই, এই কথা মনে করিয়া আবদুল্লাহ্-জননীর শোক আবার উথলিয়া উঠিল। তিনি ভগ্নকণ্ঠে কহিতে লাগিলেন, যাক সেসব কথা–বরাতে যা ছিল হয়ে গেছে, তা নিয়ে এখন মন ভার করে থেকে আর কী হবে! দোষ কারুরই নয় বাবা, সবই খোদার মরজি। তুই অনর্থক অভিমান করে থাকিস নে। আর তোর শ্বশুর যে আমাদের নিতান্ত আপনার জন। তার সঙ্গে আর অভিমান কী বাবা!
আবদুল্লাহর শ্বশুর যে বাস্তবিকই একজন বড়লোক ছিলেন, তাহা নহে। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ হইয়াও তাহার মনে বড়লোকের আত্মম্ভরিতাটুকু পুরামাত্রায় বিরাজ করিত। তার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ হীনাবস্থার লোককেই তিনি কৃপার চক্ষে দেখিতেন। এরূপ চরিত্রের লোক পিতার খালাতো এবং মাতার ফুফাতো ভাই হলেও তাহাকে নিতান্ত আপনার জন বলিয়া মনে করিয়া লইতে আবদুল্লাহর প্রবৃত্তি ছিল না। কিন্তু সে তাহার স্নেহপরায়ণা মাতার বড়ই অনুগত ছিল; তাহার নিজের ফুফাতো ভাইয়ের প্রতি সনির্বন্ধ বিরাগ দেখাইলে পাছে তাহার মনে কষ্ট হয়, এই ভাবিয়া সে অবশেষে কহিল, তা আপনি যখন বলছেন আম্মা, তখন একবার তার কাছে গিয়েই দেখি।
মাতা প্রীত হইয়া কহিলেন, হ্যাঁ বাবা তাই যা, আর দেরি করিস নে। আমি বলি কাল ভোরেই বিসমিল্লাহ্ বলে রওয়ানা হও।
.
০২.
পরদিন রাত্রি শেষ না হইতেই আবদুল্লাহর মাতা শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিলেন এবং তাড়াতাড়ি চারিটি ভাত রাঁধিয়া যখন আবদুল্লাহকে ডাকিতে গেলেন, তখনো আকাশ পরিষ্কার হয় নাই। মাতার আহ্বানে আবদুল্লাহ্ শয্যার উপর উঠিয়া চোখ কচলাইতে কচলাইতে কহিল, এত রাত থাকতে!
বাঃ রাত আর কোথায় রে? কাক-কোকিল সব ডেকে উঠল যে? নে ওঠ, নামাযটা পড়ে চাট্টি খেয়ে বেরিয়ে পড়।
এত ভোরে আবার খাব কী আম্মা?
চাট্টি ভাত বেঁধে রেখেছি বাবা–
আপনি বুঝি রাত্রে আর ঘুমোন নি, বসে বসে ভাত বেঁধেছেন?
মাতা একটু হাসিয়া কহিলেন, দেখ, হাবা ছেলে বলে কী শোন। চাট্টি ভাত রাঁধতে বুঝি সারা রাত জাগতে হয়? আমি তো এই একটু আগেই উঠলাম। এতটা পথ যাবি, চাট্টি খেয়ে না গেলে পথে ক্ষিধেয় কষ্ট পাবি যে, বাবা।
আবদুল্লাহ আলস্য ত্যাগ করিতে করিতে কহিল, তা খাওয়াটা একটু বেলা উঠলেও তো হতে পারত।
বেলা উঠে গেলে রোদে কষ্ট পাবি। নে, এখন ওঠ; আর আলিস্যি করিস নে।
আবদুল্লাহ্ কহিল, রোদে কষ্ট পাব কেন, আম্মা, আমি তো আর একটানে অতটা পথ হাঁটব না, পথে জিরিয়ে যাব ঠিক করেছি।
কোথায় জিরুবি?
কেন, শাহপাড়ায় গোলদারদের বাড়ি? তারা লোক বড় ভালো, আমাকে খুব খাতির করে।