এই করুণ বিদায়ে সালেহার বুকের ভিতরটায় যেন একবার কাপিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু সে-কম্পন আসন্ন বিরহের ব্যথার কম্পন নহে। তাহার অপেক্ষাও গভীর অজ্ঞাত অকল্যাণের একটা আতঙ্ক-কম্পন। স্বতঃই তাহার মনে হইয়াছিল, কোথায় কী যেন বাকি রহিয়া গেল। কী যেন প্রাণের বস্তুকে এইখানেই বিসর্জন দিয়া গেল। বরিহাটীতে কিছুদিন একসঙ্গে বাস করার ফলে সালেহা যেন একটু বদলিয়া গিয়াছিল। পিতার আদেশ অমান্য করার মতো শিক্ষা বা মন তাহার ছিল না; তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাহাকে পিতার অনুবর্তিনী হইতে হইয়াছিল।
যাহা হউক, ১০০ টাকা বেতনে হেডমাস্টার হওয়ার সংবাদ পাইয়া আবদুল্লাহ্ মনে মনে ঠিক করিয়া ফেলিল যে, রসুলপুর পৌঁছিয়াই সে সালেহাকে তথায় আনিয়া তাহার মনোমতো করিয়া শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিবে। বরিহাটীতে সালেহার কথাবার্তায় এবং চলাফেরায় আবদুল্লাহর বেশ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, হয়তো শিক্ষা দিলে সালেহা তাহা গ্রহণ করিতে পারিবে।
স্কুলের কাজকর্ম ভালোরূপে বুঝিয়া পড়িয়া লইয়া আবদুল্লাহ্ এ সম্বন্ধে মীর সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আগামী বড়দিনের বন্ধে সালেহাকে লইয়া আসাই সাব্যস্ত করিয়া ফেলিল।
আবদুল্লাহর মা মীর সাহেবের বাড়িতে থাকিতে কখনই রাজি হইলেন না, কারণ মীর সাহেব সুদের সংস্রবে আছেন। অতএব সাব্যস্ত হইল যে মীর সাহেবের একটি রায়তের। বাড়ির সীমানায় বিঘাখানেক জমি আবদুল্লাহকে দেওয়া হইবে। শীঘ্রই সেখানে ঘর-দরজা তৈয়ার করিয়া একটি ছোট বাসা নির্মিত হইল।
মায়ের অনুমতি ব্যতিরেকে কিছুই করা উচিত হইবে না, তাই স্কুল বন্ধ হইবার দিনই সন্ধ্যায় রওয়ানা হইয়া পরদিন দ্বিপ্রহরে আবদুল্লাহ আসিয়া পীরগঞ্জে পৌঁছিল। পুত্র বি-এ পাস। করিয়া এখন ১০০ টাকা বেতনের চাকরি পাইয়াছে, ভবিষ্যতে ৪০০-৫০০ টাকা বেতনের আশা আছে। আজ আবদুল্লাহ্ বাড়ি পৌঁছায় তার মুখচন্দ্রের পানে চাহিয়া আবদুল্লাহর মার প্রাণ আহ্লাদে নাচিয়া উঠিল, তার বুক গর্বে ও আনন্দে স্ফীত হইয়া উঠিল। আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেও বুঝি কোনো মানুষের এতখানি হয় না। আজীবন অভাব-অনটনে কাটিয়াছে। কত সাধ, কত আশা অঙ্কুরেই শেষ হইয়াছে। শৈশবের, কৈশোরের, যৌবনের কত অপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি জ্বলন্ত চিত্র চকিতে তাহার মানসপটে ফুটিয়া উঠিয়া সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর কথা মনে পড়িল। তার আজিকার এই আনন্দের অংশীদার কোথায় কোন অজানা দেশে চলিয়া গিয়াছেন। ভাগ লইতে আসিতেছেন না। আবদুল্লাহর জননীর দুই চোখ ছাপাইয়া দরূদ করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। যথাসাধ্য নিজকে সংযত করিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে তিনি কহিলেন, ভালো আছ তো বাবা, বউমাকে আর হালিমাকে নিয়ে এলে না কেন?
আবদুল্লাহ উত্তর করিল, সে পরামর্শ হবে এখন পরে।
সম্মুখে বসিয়া আদর করিয়া, আহার করাইয়া, নিজ হাতে বিছানা পাতিয়া আবদুল্লাহকে বিশ্রাম করিবার অবসর দিয়া জননী নাশতা ইত্যাদির বন্দোবস্তে লাগিয়া গেলেন।
পরদিন অপরাহ্নে আবদুল্লাহ্ মাকে বলিল, তা হলে এক কাজ করলে হয় না–চলুন না আম্মা, আপনাদিগকে রসুলপুরে নিয়ে যাই।
মা কহিলেন, তাই তো ভাবছি, তোমার সেখানে খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে, তা আমার তো যেতেই মন চায়, তবে গেলে ঘরদোর দেখবে কে, সেই কথাই ভাবছি। গেলে তো করিমনকেও নিয়ে যেতে হয়।
আবদুল্লাহ্ কহিল, সেই তো কথা, তবে যদি বলেন তো আপনাদের বউকে সেখানে নিয়ে যাই।
আবদুল্লাহর জননী কহিলেন, বউমা তো ছেলেমানুষ, একলা থাকবে কেমন করে! তবে এক কাজ করলে হয়; ওই যে গোপালের মা, ওকে বাড়ি রেখে গেলে ও দেখাশুনা করবে।
শেষ এই কথাই সাব্যস্ত হইল।
যথাসময় মাতাসহ একবালপুর পৌঁছিয়া সালেহা ও হালিমাকে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করা হইল।
সৈয়দ সাহেব হালিমার যাওয়া সম্বন্ধে বিশেষ কিছু আপত্তি করিলেন না, তাহার প্রথম কারণ হালিমা অন্য বংশের মেয়ে। দ্বিতীয় কারণ আবদুল কাদেরকে তো তিনি ভালো করিয়াই জানিতেন। হয়তো শেষ পর্যন্ত আবদুল কাদের তাহার মর্যাদা রক্ষা করিবে না। কিন্তু সালেহার সম্বন্ধে তিনি ঘোর আপত্তি করিয়া বসিলেন। প্রথম কারণ সৈয়দ সাহেব মীর সাহেবের সংস্রবে আসাটা শুধু অপমানজনক নয়, ধর্মবিরুদ্ধ বলিয়া মনে করিতেন এবং আবদুল্লাহ্ এখন মীর সাহেবেরই একজন ভক্ত এবং সদাসর্বদা মীরের সঙ্গে ওঠা-বসা, মীরের পরামর্শে সব কাজকর্ম করিয়া থাকে। সৈয়দ সাহেবের আন্তরিক বিশ্বাস যে মীর সাহেব মুসলমান হইতে খারিজ হইয়াছেন এবং শরীফ ঘরের মুসলমানদের উচিত অন্ততপক্ষে তার সঙ্গে তরুকে মাওয়ালাত (নন্-কো-অপারেশন) করা।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা বাদ মগরেব আবদুল্লাহকে ডাকিয়া লইয়া সৈয়দ সাহেব বেশ গম্ভীরভাবে বলিলেন, বস বাবা। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সৈয়দ সাহেব বলিলেন, তা বাবা, আমি একটা খোলাসা কথা বলব। তোমরা যে যাই বল না কেন আমি ওসব কারবারে নেই। আমি সালেহাকে রসুলপুর যেতে দেব না। ওর আখেরাতের দিকে আমার তো দেখা চাই। তোমরা সব আজকাল শরা-শরীয়ত একদম উড়িয়ে দিয়েছ। হারাম-হালাল মান না। তা যাই হোক, সব চুলোয় যাক। ওদিকে, বাবা ওই যে মীর সাহেব লোকটার সঙ্গে তোমাদের অত মাখামাখি কেন? বলি, তোমরাও কি সুদ খাবে নাকি! আস্তাগফেউল্লাহ্, কী মুশকিলেই যে আমি পড়েছি! এইসব আমার কিসমতে ছিল! তা ছাড়া আরো একটা কথা বাবা, নিয়ে যেতে চাচ্ছ, যাবে কেমন করে? এখন তো নৌকা চলবে না।