আবদুল্লাহ্ কহিল, কিন্তু বিলেতের মতো সভ্য দেশেও লর্ড ফ্যামিলির লোকেরা সাধারণ লোকের সঙ্গে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না।
মীর সাহেব কহিলেন, জাত্যাভিমান তাদের মধ্যেও আছে। কিন্তু তাদের আছে বলেই যে সেটা ভালো বলে মেনে নিতে হবে, তার কোনো মানে নেই। যখন দেখতেই পাচ্ছি আমাদের নিজেদের সমাজে এই রকম আপনা-আপনির ভিতর বিবাহের ফল ভালো হচ্ছে না, অনেক স্থলেই সন্তান রোগা, নিস্তেজ, বোকা এইসব হচ্চে আর যেখানেই একটু বিভিন্ন রক্তের সংমিশ্রণ হচ্ছে, প্রায়ই সেখানে দেখতে পাই সন্তান সতেজ, সবল এবং মেধাবী হয়ে ওঠে, তখন আর কোনো যুক্তিই মানতে চাই না। আবার দেখ, মুরব্বিদের। মুখে শুনেছি, সেকালে নাকি বাড়ি বাড়ি লোকজনে ভরা ছিল, তারা বলেন, দুনিয়া আখের হয়ে এসেছে, তাই এখন সব বিরান হয়ে উঠছে! লোকসংখ্যা যে মোটের উপর বাড়ছে, সেটা তারা খেয়াল করেন না; শরীফদের ঘর উজাড় হয়ে আসছে, এইটেই কেবল লক্ষ্য করেন। তা উজাড় তো হবেই! মেয়েগুলোকে কেউ কেউ আইবুড়ো করে রাখেন আর নিতান্তই বে দেন তো সে আপনা-আপনির মধ্যে, যার ফল ভালো হয় না–বিধবা হলে। আর বে দেবেন না; এত করে আশরাফ সমাজে লোক বাড়বে কী করে? এ আশরাফ সমাজের আর মঙ্গল নেই। আর দুই-এক পুরুষের মধ্যেই এঁদের দফা শেষ হবে; আর এখন যাদের দেখে এঁরা নাক সিটকাচ্ছেন, তারাই তখন মানুষ হয়ে তাদের সমাজকেই বড় করে তুলবে।
আবদুল্লাহ্ কহিল, সে কথা ঠিক, ফুপাজান। এই তো দেখতে পাই, কলকাতার মেসগুলোতে আমাদের এদিককার যত ছাত্র আছে, তার মধ্যে আশরাফ সমাজের ছেলে খুবই কম। লেখাপড়া শিখে ওরা যখন মানুষ হবে তখন এঁরা কোথায় থাকবেন?
সাএলের দলে গিয়ে ভিড় বাড়াবেন। এখনো যদি এঁরা জাত্যাভিমান ছেড়ে, অন্যান্য উন্নতিশীল সমাজের সঙ্গে হসব-নসব কত্তে আরম্ভ করেন, তা হলে এঁদের বংশের উন্নতি হতে পারে। নইলে ক্রমেই অধঃপাত! যাক সে কথা বলছিলাম মালেকার বিয়ের কথা। বাদশাহ্ মিয়া তো কিছুতেই রাজি হবেন না। ভাবছি কোনো উপায় কত্তে পারি কি না। আলতাফ ছেলেটা ভালো; বি-এ পাস করেছে, ল পড়ছে। বারে বেশ শাইন কত্তে পারবে। দেখি যদি একান্ত না হয় অন্য কোথাও চেষ্টা কত্তে হবে। তুমিও একটু সন্ধানে থেকো, বাবা।
আবদুল্লাহ্ কহিল, জি আচ্ছা, তা দেখব। তবে আশরাফ সমাজে ছেলে পাওয়া যাবে বলে বোধ হয় না…
নাই-বা হল আশরাফ সমাজে। ছেলে ভালো, সচ্চরিত্র, সুস্থ, সবল–বাস, আর কোনো সিফাৎ চাই নে। ডিপুটি তমিজউদ্দিনের কথা শুনেছ তো? তার বাপ তো সুপারি, নারকোল, তরিতরকারি মাথায় করে নিয়ে হাটে বেচতেন। ছেলে যখন বি-এ পাস কল্লে, তখনো তিনি তার নিজের ব্যবসায় ছাড়েন নি। হাইকোর্টের উকিল আবদুল জলিল ছেলেটাকে ভালো দেখে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট করে নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। তমিজউদ্দিন মারা গেছেন, তার ছেলে বদরউদ্দীন এখন ওকালতি কচ্ছেন, দিব্বি পসার। দেখ তো, একটা নিম্নস্তরের পরিবারের কেমন ধা করে উন্নতি হয়ে গেল! আর ওই ছেলে যদি ওই সহানুভূতিটুকুর অভাবে লেখাপড়া শিখতে না পেত তবে বাঙ্গালাদেশে তো আজ একটা উন্নত পরিবার কম থেকে যেত! ওসব শরাফতের মোহ ছেড়ে দেও বাবা। ছেলে ভালো পাও আমাকে এনে দেও, তা সে যেমন। ঘরেরই হোক না কেন। কেবল দেখা চাই, ছেলেটি সুস্থ, সচ্চরিত্র আর কর্মক্ষম কি না– বাস্…
আর লেখাপড়া?
হ্যাঁ, সেটা তো চাই-ই…
তবে আপনি বংশটা একেবারেই দেখবেন না? মনে করুন এমনও তো হতে পারে যে, ছেলেটি সব বিষয়ে ভালো, কিন্তু তাদের পরিবারের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা নেই, culture নেই, নিম্নশ্রেণীর লোকের মতনই তাদের চাল-চলন–কেবল ছেলেটি লেখাপড়া শেখবার সুযোগ পেয়ে বি-এ পাস কত্তে পেরেছে। তার সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিলে তো মেয়েকে নিতান্ত হীন সংস্রবে জীবন কাটাতে হবে…
মীর সাহেব কহিলেন, আমি কি আর সে কথা ভেবে দেখি নি বাবা? তেমন ঘরের কথা আমি বলছি নে। অবশ্য তাও দোষের হয় না যদি ছেলেটি পরিবার থেকে আলাদা হয়ে থাকে–যেমন ধর, তাকে যদি সারাজীবন চাকরিতে বা ব্যবসায় উপলক্ষে বিদেশে বিদেশে কাটাতে হয়। আর তা ছাড়া শিক্ষিত লোকের মধ্যে আজকাল একটা tendency দেখা যাচ্ছে। পরিবারের একান্নবর্তিতা ভেঙে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হয়ে থাকবার দিকে। কাজেই তেমন ক্ষেত্রে মেয়েকে কোনো অসুবিধায় পড়বার কথা নয়। যেখানে পরিবার একান্নবর্তী সেখানে অবশ্য। কেবল ছেলে দেখলে চলে না, এ কথা মানি। তবে কবরের ওপারের দিকে তাকাবার আমি কোনো দরকার দেখি না…
আবদুল্লাহ্ কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কবরের ওপারে কী রকম?
মীর সাহেব কহিলেন, অর্থাৎ যারা আছে, তাদের দেখ, তাদের পূর্বপুরুষরা কী ছিল না ছিল দেখবার দরকার নেই…
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা না দেখলে কি যারা আছে তাদের চরিত্র, চালচলন সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়?
কেন যাবে না? তাদের একটু study করে দেখে নিলেই হল। তা ছাড়া তুমি কি মনে কর ঘরানা হলেই চরিত্র, চালচলন ভালো হবে? স্ত্রীকে ধরে মারে এমন হতভাগা শরীফজাদা কি নেই?
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা তো বটেই।
তবে বুঝেই দেখ, যে ছেলেটিকে চাই, তাকে আর তার immediate environment, কেবল এই দেখব; তার ওদিকে দেখব না…! তুমি একটু বস বাবা–বাইরে দুটো লোক বসিয়ে রেখে এসেছি, তাদের বিদায় করে আসি… এই বলিয়া মীর সাহেব উঠিয়া বাহিরে আসিলেন, এবং কহিলেন, দেখ বসির, তোমার ও টাকা আমি মাফ করে দিলাম। যখন ডুবেছে, তখন তোমারও গেছে, আমারও গেছে। তা যাক্ তুমি কাল এসো; যদি খোদা তোমাকে দেয়, তবে ও টাকা শোধ কোরো। কিছু টাকা দেব, ফের কারবার কোরো। এখন রাত হল, বাড়িতেও মেহমান। তোমরা আজ এস গিয়ে।
৩১-৩৫. সৈয়দ সাহেব
সৈয়দ সাহেব যেদিন সালেহাকে বরিহাটী হইতে লইয়া আসেন, সেদিন আবদুল্লাহ্ অন্তরে অন্তরে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হইলেও মুখে কোনো কথাই কহে নাই। সালেহা যখন বিদায়ের জন্য কদমবুসি করিয়াছিল, তখন আবদুল্লাহ হতভম্বের মতো দাঁড়াইয়াই ছিল। সালেহা একবার সজল করুণ-দৃষ্টি তুলিয়া আবদুল্লাহর মুখপানে চাহিতেই আবদুল্লাহর চোখ দুটি ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল। গও বাহিয়া দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়াইয়া পড়িয়াছিল। সালেহা তাহা দেখিয়া আর সেখানে দাঁড়াইতে পারে নাই। ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। একটু পরেই নিজেকে কঞ্চিৎ শান্ত করিয়া সে আবার সেই ঘরে ঢুকিয়াছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ্ তখন বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। কাজেই আর সাক্ষাতের সুবিণ হয় নাই।