আবদুল্লাহ্ কহিল, আপনিও আসুন, ফুপাজান…
আমার তো এ সময়ে খাওয়া অভ্যাস নেই–তবে বসি তোমার সঙ্গে একটু–এই বলিয়া মীরসাহেব আবদুল্লাহর সহিত নাশতা করিতে বসিয়া গেলেন।
ফুপাজান তো একলা মানুষ; তবে এসব নাশতা কোথা হইতে আসিল? আবদুল্লাহর কৌতূহল হইল; সে জিজ্ঞাসা করিল, এগুলো কে তয়ের করেছে; ফুপাজান?
মীর সাহেব কহিলেন, কেন, ভালো হয় নি?
না, না, ভালো হবে না কেন? বেশ চমৎকার হয়েছে। তবে আপনার এখানে এসব নাশতা তয়ের করার তো কেউ নেই, তাই জিজ্ঞেস কচ্ছিলাম…
মীর সাহেব একটু হাসিয়া কহিল, ওঃ, তা বুঝি জান না? আমার এক আম্মা এসেছেন যে!
কে? ভাবী সাহেবা?
না মালেকা, আমার ছোট আম্মা।
কবে এলেন তিনি?
এই কদিন হল। মইনুদ্দীন মারা গেছে তা বোধহয় জান…
কই না! কবে?
এই পূজার ছুটির কদিন আগেই। হঠাৎ কলেরা হয়েছিল।
আবদুল্লাহ্ কেবল একবার অহো! বলিয়া অত্যন্ত বিষমুখে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মীর সাহেব বলিতে লাগিলেন, মেয়েটা বিধবা হয়ে একেবারে নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিল– বুবুও তো আর নেই যে তার কাছে এসে থাকবে…
কেন, ভাসুর বুঝি জায়গা দিলেন না?
দিয়েছিলেন; কিন্তু দুই জায়ে বনল না। কাজেই তিনি বাধ্য হয়ে মালেকাকে আবদুল খালেকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
কেন, বনল না কেন? মালেকার তো ছেলেপিলে নেই, নির্ঝঞ্ঝাট…
সে জন্যে না; অত বড় ঘরের মেয়ে–সৈয়দজাদী, বাপ জমিদার আবার সজজ– জজিয়তিও মধ্যে মধ্যে করে থাকেন তিনি কি আর সামান্য গেরস্তের মেয়ের সঙ্গে ঘর কত্তে পারেন?
হ্যাঁ, তা ঠিক ফুপাজান! শুনেছি তিনি স্বামীকেও বড় একটা কেয়ার করেন না…
আরে কেয়ার করা তো দূরের কথা; তিনি স্বামীর কথায় নাকি বলে থাকেন, ওঃ এ্যাঁয়সা ডিবৃটি কেত্তা মেরা বাপকা জুতা সাফ কবৃনে কে লিয়ে রাখৃখা গিয়া হায়!
বটে? তবে তো মহীউদ্দিন সাহেব খুব সুখেই ঘর কচ্ছেন!
হ্যাঁ! সুখ বলে সুখ? বাড়িতে তিনি যে কী হালে থাকেন, তা শুনলে কান্না আসে। তার বাসন, পেয়ালা, গেলাস, বদনা সব আলাদা। তিনি যে গেলাসে পানি খান, বিবি সাহেব সে গেলাস ছোঁনও না…
এতদূর!
এই বোঝ! মস্ত ভয়ঙ্কর বড় ঘরের মেয়ে–স্বামী হলেই-বা কী, তার সঙ্গে তুলনায় সে তো ছোটলোক।
আবদুল্লাহ একটু ভাবিয়া কহিল, মহীউদ্দিন সাহেব তো নিতান্ত যে-সে লোক নন। বেশ খাস সম্পত্তি আছে, পুরোনো জমিদারের ঘর–তার উপর ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, –এতেও যদি তিনি ছোটলোক হলেন, তবে ও বিবি সাহেবের তুল্য স্বামী পেতেন কোথায়? আর যদি এতই ছোটলোক বলে ওঁরা বিবেচনা করেন, তবে বিয়ে না দিলেই হত!
বিয়ে দিয়েছিলেন মহীউদ্দিনের বাপ অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে–বড় ঘরে ছেলের বিয়ে দিয়ে কৃতার্থ হবেন, সেই জন্য আর কি! জজ সাহেবও দেখলেন, এমন ছেলে আর পাবেন। না, কাজেই তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
আবদুল্লাহ্ একটু ভাবিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া কহিল, বেচারা মহীউদ্দিন সাহেবের জন্যে বড় দুঃখ হয়।
মীর সাহেব কহিলেন, বরাতে দুঃখু থাকলে আর কে কী করবে বল! সে কথা থাক, এখন মালেকার একটা গতি করতে হয়, তাই ভাবছি।
কী কত্তে চান?
ফের বিয়ে দেব, মনে কচ্ছি।
বিয়ে দেবেন? ছেলে পাবেন কোথায়? বিধবার বিয়ের কথা শুনলে সব্বাই শিউরে উঠবে এক্কেবারে!
সত্যিই তাই। আমি আলতাফের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব করিয়েছিলাম। আলতাফ রাজি আছে, কিন্তু তার বাপ শুনে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিল…
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা তো উঠবেনই! আমাদেরও ক্রমে হিন্দুদের দশা হয়ে উঠল আর কি! ভালো মানুষের বিশেষ করে গরিব ভালো মানুষের ঘরে তো আজকাল বিধবাদের বিয়ে হয়ই না।
মীর সাহেব কহিলেন, ও তো হিন্দুদের দেখাদেখি। আর জাত্যাভিমানও আছে। বিধবাদের কথা ছেড়ে দাও, কত আইবুড়ো মেয়েরই বিয়ে হচ্ছে না। এই দেখ না, আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই কত মেয়ের বয়স ত্রিশ বছর পার হয়ে গেল, বিয়ে হচ্ছে না। এরা আলমগীর বাদশার অবতার হয়ে এসেছেন কিনা, শাহ্জাদা পাচ্ছেন না, কাজেই শাহজাদীদের বিয়ে হচ্ছে না।
আবদুল্লাহ্ কহিল, আমার শ্বশুর একদিন কার বিয়ের কথায় বলছিলেন, শরীফজাদীর বিয়ের জন্যে আবার এত ভাবনা কেন? না হলেই-বা কী?
চিরকাল আইবুড়ো থাকবে?
তাঁর মতে থাকলেও দোষ নেই–শরাফতির ভেলায় চড়ে ভবসিন্ধু পার হয়ে যাবে।
মীর সাহেব একটু হাসিয়া কহিলেন, খোদা করে যেন সব শরীফজাদীই ওই রকম করে ভবসিন্ধু পার হয়ে যান; তা হলে শরীফগোষ্ঠী নিপাত হবে শিগগির, মুসলমান সমাজও নিস্তার পাবে।
উভয়ে হাসিতে লাগিলেন। মীর সাহেব আবার কহিলেন, দেখ সমাজে বিয়ে-থাওয়া কয়েকটা নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যেই আবদ্ধ–তার বাইরে কথা উঠলে মুরব্বিরা আপত্তি করে বলেন, ওদের সঙ্গে কোনো পুরুষে হসব-নসব নেই। অর্থাৎ যাদের সঙ্গে ইতিপূর্বে হসব নসব হয় নি, তারা যেন সবই অ-জাত! এই রকম করে কেবল আপনা-আপৃনির মধ্যেই শাদি-বিয়ে অনেক পুরুষ ধরে চলে আসছে। আর তার ফলে শারীরিক, মানসিক, সব রকম অধঃপাত হচ্চে। শাদি-বিয়ে যত বাইরে বাইরে হবে, বংশাবলি ততই সতেজ হবে। তাই বলে এমন কথা বলি নে যে ভদ্রঘরের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে হেলো-চাষার ছেলে-মেয়ের বে থা হোক। দেখতে হবে মানসিক হিসাবে বিশেষ কোনো তফাত না থাকে। মনে কর, তিন চার পুরুষ আগে যারা চাষা ছিল, আজ তাদের বংশে লেখাপড়ার চর্চা হয়েছে, অবস্থা ফিরেছে, স্বভাব-চরিত্র ভালো, বড় বড় সমাজে আমাদের সঙ্গে সমানভাবে মেলামেশা কচ্চে, তাদের সঙ্গে হসব-নসবে কোনো দোষ হতে পারে না। এক কালে চাষা ছিল বলে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্তই তাদের বংশ ঘৃণিত হয়ে থাকবে, তার কোনো মানে নেই। আর যারা নতুন উন্নতি কচ্চে, তাদের সঙ্গে রক্তের সংমিশ্রণ হলে আজ-কালকার শরীফজাদাদের নিস্তেজ রক্ত একটু সতেজ হয়ে উঠবে–আর এদের বংশানুক্রমিক উৎকর্ষেরও কিছু ফল ওরা পাবে– সুতরাং উভয় পক্ষেরই লাভ।