তাহারা আসিয়া কাদার ভিতর নামিয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ নামিবার উপক্রম করিতেছিল, কিন্তু তাহারা কহিল, আপনি আর নামবিন ক্যান হুজুর? আমরাই ঠেলে দি তুলে–আপনি বসেন। গরু দুইটি কাদার ভিতর শুইয়া শুইয়া এতক্ষণে একটু বিশ্রাম করিয়া লইয়াছে। গাড়োয়ানের পাঁচনবাড়ির দুটা খোঁচা খাইয়াই তাহারা উঠিয়া পড়িল। চার জন লোকে চাকা ঠেলিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি ওপারে তুলিয়া ফেলিল। আবদুল্লাহর জিনিসপত্রগুলিও তাহারা তথায় মাথায় করিয়া পার করিয়া দিয়া আসিল।
আবদুল্লাহ্ তাহাদিগকে কহিল, তোমরা আজ আমার বড় উপকার কল্লে বাপু না হলে আমার যে আজ কী উপায় হত তার ঠিক নেই। এদের কত দেবার কথা আছে। গাড়োয়ান?
গাড়োয়ান কহিল, আমি পুস্ কছিলাম, কত লেবা; তা ওরা কলে খুশি হয়ে যা দেন, আমরা আর কী কব!
আবদুল্লাহ্ একটি টাকা বাহির করিয়া দিল। তাহারা খুশি হইয়া সালাম করিয়া চলিয়া গেল।
যাইবার পূর্বে আবদুল্লাহ্ সেই ডাবা-প্রেমিক ব্রাহ্মণটির দিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল ঠাকুরমশায় তাহাদের দিকেই তাকাইয়া আছেন এবং সুস্থচিত্তে ধূমপান করিতেছেন।
.
৩০.
মগরেবের কিঞ্চিৎ পূর্বে মীরসাহেব মসজিদে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বাহিরে আসিয়াছেন, এমন সময় দুইটি লোক বৈঠকখানার বারান্দা হইতে নামিয়া আসিয়া একেবারে তাহার পা জড়াইয়া করুণস্বরে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, আমাগোর সর্বনাশ হয়ে গেছে হুজুর, এ্যাঁহোন আপনি যদি বাঁচান তো বাঁচি!
হঠাৎ এইরূপ আক্রান্ত হইয়া মীরসাহেব ত্রস্তভাবে পা টানিয়া লইলেন এবং কহিলেন, আর কে? বসির মাঝি? কী, কী, হয়েছে কী?
বসির কহিল, আর কী হবে হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে, আর কী কব! লাও ডুবে গেছে, খোদা জানডা বাঁচাইছে, আর কিস্সু নেই!
এ্যাঁ! নৌকো ডুবে গেছে? কোথায়? কেমন করে ডুবল?
ম্যাগনায়। পাট বোজাই করে নে যাতিছেলম, আটশো ট্যাহার পাট হুজুর! আমার যথাসর্বিশ্যি, হুজুর! অইন্দে গোনে এট্টা বাকের মুহি মস্ত এট্টা ইষ্টিমার আস্যে পড়ল, সামাল দিতে পাল্লাম না! লার পর দে চলে গেল, সোতের মুহি সবই ভাইসে গেল!
মীরসাহেব পরম দুঃখিত চিত্তে বলিয়া উঠিলেন, ওহো!
বসির চক্ষের জলে বক্ষ ভাসাইয়া কহিতে লাগিল, হুজুর, কিস্সু বাঁচাতি পালাম না! গহিন গাঙ, তাতে আঁদার রাত, লারও ঠিকানা কত্তি পালাম না। কমে ভাইসে গেল কিছুই ঠাওর করি পালাম না! এ্যাঁহোন উপায় কী হুজুর? আমার যে আর কিসু নেই।
মীরসাহেব গভীর সহানুভূতির সহিত কহিলেন, তাই তো বসির! তোমার তো বড়ই বিপদ গেছে দেখছি। বলিয়া বৈঠকখানার তক্তপোশের উপর উঠিয়া বসিলেন। বসির এবং তাহার সঙ্গের লোকটিও বারান্দায় উঠিয়া একটু দূরে মাটির উপর বসিয়া পড়িল।
বসিরের সঙ্গের লোকটি তাহার নৌকার একজন মাল্লা। সে কিয়ৎক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া চিন্তাকুলভাবে আপন মনে কহিতে লাগিল, নাইয়ার নাও গেল, মাহাজোনের ট্যাহা। গেল, হের লাইগা কিসু না; কিন্তু–উ কাণ্ডহান অইল কী?
বসির কহিল, এ্যাঁহোন আমি লাইয়্যারেই বা কী বুজ দি, আর হুজুরির ট্যাহারই বা কী করি! আমি ধোনে-পরানে মলাম রে আল্লাহ্!
মীরসাহেব কহিলেন, আমার টাকার জন্য তুমি ভেবো না, বসির। তোমার সঙ্গে আমার অনেক দিনের কারবার! তোমাকে সৎ লোক বলেই জানি। তুমি তো আর ইচ্ছে করে আমার টাকা মার নি! খোদার মরজি সবই–তার উপর তো কারুর কোনো হাত নেই।
এমন সময় একখানি গরুর গাড়ি করুণ কাতর রবে ক্লান্ত মন্থরগতিতে আসিয়া মীরসাহেবের বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইল। আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি গাড়ি হইতে নামিয়া আসিল, মীর সাহেবও বৈঠকখানার বারান্দা হইতে নামিয়া আসিতে আসিতে কহিলেন, এস এস, বাবা; এত দেরি যে?
আবদুল্লাহ্ কদমবুসি করিয়া কহিল, পথে একটা মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম–তা পরে বলবখন। আমার চিঠি পেয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আজ সকালেই পেয়েছি। বড় খুশি হলাম যে তুমি আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে এলে তোমার পত্র পড়ে অবধি খোদার কাছে হাজার হাজার শোকর কচ্ছি।
তবিয়ত ভালো তো?
হ্যাঁ, বাবা, ভালোই আছি।
আমি মনে করেছিলাম হয়তো আপনি বাড়িতে নেই…
না থাকবারই কথা বটে–কিন্তু থেকে যেতে হয়েছে। বোধ করি তুমি আসবে বলেই খোদা আমাকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেন নি। বলিয়া মীরসাহেব স্মিতমুখে আবদুল্লাহর স্কন্ধে হাত দিলেন।
আবদুল্লাহ্ও হাসিমুখে কহিল, তা বেশ হয়েছে, আপনি আছেন, ফুপাজান! নইলে আমার ভারি অসুবিধে হত।
মীর সাহেব কহিলেন, এস, ঘরে এস। নামাযটা পড়ে নি। ওযুর পানি চাই?
জি না, পথেই আসর পড়ে নিয়েছি। ওযু আছে।
অতঃপর মীরসাহেব গাড়োয়ানকে জিনিসপত্র তুলিয়া রাখিতে বলিয়া এবং বসিরকে বসিবার জন্য ইশারা করিয়া আবদুল্লাহকে লইয়া নামায পড়িবার জন্য বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন। উলফৎ কিঞ্চিৎ পূর্বে আলো দিয়া গিয়াছিল।
নামায বাদ মীর সাহেব অন্দরে গিয়া আবদুল্লাহর জন্য কিঞ্চিৎ নাশতার বন্দোবস্ত করিতে বলিয়া আসিলেন। একটু পরেই একটা বাঁদী নাশতার খাঞ্চা চিলমচি, বদনা দস্তরখানা প্রভৃতি একে একে লইয়া আসিল। মীরসাহেব খানপোষ উঠাইয়া ফেলিলেন; খাঞ্চার উপর এক রেকাবি সমুসা, এক তশতরি কুমড়ার মোরব্বা, এক তশতরি আণ্ডার হালুয়া ছিল, তিনি সেগুলি একে একে দস্তরখানে সাজাইয়া দিলেন।