এই কথায় কিঞ্চিৎ ভরসা পাইয়া আবদুল্লাহ গাড়োয়ানের সঙ্গে চলিল। সরুপথ দিয়া একটু গিয়াই দূর হইতে বাড়িখানি দেখাইয়া দিয়া গাড়োয়ান কহিল, ওই বাড়ি; ওই যে বটেখানা দ্যাহা যায়। আপনি যান, আমি গাড়ির কাছে থাকলাম।
আবদুল্লাহ্ গিয়া বৈঠকখানার বারান্দার উপর উঠিল। গৃহমধ্য হইতে শব্দ আসিল, কে?
আবদুল্লাহ্ কহিল, মশায়, আমি বিদেশী, একটু মুশকিলে পড়ে আপনার কাছে… বলিতে বলিতে ঘরে উঠিবার জন্য পা বাড়াইল।
টুপি-চাপকান পরিহিত অদ্ভুত মূর্তিখানি সটান ঘরের মধ্যে উঠিতে উদ্যত হইয়াছে দেখিয়া গৃহমধ্যস্থ লোকটি সত্রাসে হাঁ হাঁ, করেন কী, করেন কী, বাইরে দাঁড়ান, বাইরে দাঁড়ান বলিতে বলিতে তক্তপোশ হইতে নামিয়া পড়িলেন। আবদুল্লাহ্ অপ্রস্তুত হইয়া তাড়াতাড়ি পা টানিয়া লইয়া বারান্দায় সরিয়া দাঁড়াইলেন।
কী চান মশায়? সেই লোকটি দরজার গবরাটের উপর দাঁড়াইয়া দুই হাতে চৌকাঠের বাজু দুটি ধরিয়া, একটু রুষ্ট স্বরে এই প্রশ্ন করিলেন।
আবদুল্লাহ্ যথাশক্তি বিনয়ের ভাব দেখাইয়া কহিল, মশায় আমি গরুর গাড়ি করে যাচ্ছিলাম, গ্রামের মধ্যে এসে দেখি রাস্তার এক জায়গায় ভাঙা, গাড়ি চলা অসম্ভব। শুনলাম। মশায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে একটা পথ আছে, যদি দয়া করে…
লোকটি রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, হ্যাঃ, তোমার গাড়ি চলে না চলে তা আমার কী? আমার বাড়ির উপর দিয়ে তো আর সদর রাস্তা নয় যে, যে আসবে তাকেই পথ ছেড়ে দিতে হবে…
আবদুল্লাহ্ একটু দৃঢ়স্বরে কহিল, মশায়, বিপদে পড়ে একটা অনুরোধ কত্তে এসেছিলাম, তাতে আপনি চটছেন কেন? পথ চেয়েছি বলে তো আর কেড়ে নিতে আসি নি। সোজা বললেই হয়, না, দেব না!
ওঃ, ভারি তো লবাব দেখি! কে হে তুমি, বাড়ি বয়ে এসে লম্বা লম্বা কথা কইতে লেগেছ?
লম্বা কথা কিছু কই নি মশায়, একটু অনুগ্রহ প্রার্থনা কত্তে এসেছিলাম। থাক, আপনাকে আর কোনো অনুগ্রহ কত্তে হবে না, মেজাজও খারাপ কত্তে হবে না–আমি বিদায় হচ্চি।
লোকটা গজর গজর করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ্ ফিরিয়া চলিল। তাহাকে বিষমুখে ফিরিতে দেখিয়া গাড়োয়ান কহিল, দেলে না বুজি? আমি জানি ও ঠাহুর ভারি ত্যান্দোড়। তবু আপনারে একবার যাতি কলাম, ভদ্দরলোক দেখলি যদি যাতি দেয়।
আবদুল্লাহ্ কহিল, এস, এক কাজ করা যাক। জিনিসপত্তর গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দেও গাড়ি নামিয়ে। তুমি এক চাকা ঠেল, আমি এক চাকা ঠেলি–গরুও টানুক, তা হলে গাড়ি ঠিক উঠে যাবে।
গাড়োয়ান একটু ইতস্তত করিয়া কহিল, আপনি এই হাবোড়ের মদ্দি নামবেন হুজুর?
তা কী করব! দায়ে ঠেকলে সবই কত্তে হয়। নেও আর দেরি কোরো না। এই বলিয়া আবদুল্লাহ বিছানা খুলিয়া একটা ময়লা ধুতি বাহির করিল, এবং পোশাক ছাড়িয়া মালকোচা মারিল। গাড়োয়ান তোরঙ্গ এবং বিছানা গাড়ি হইতে উঠাইয়া রাস্তার কিনারায় রাখিয়া দিয়া একটা গরুর লেজ মলিয়া এবং অপর একটার পিঠে পাঁচনবাড়ি কসিয়া র্-র্-র্ হেট্-হেট্ করিতে করিতে গাড়ি চালাইয়া দিল। ভাঙনের সেই খাড়া পাড়ের উপর দিয়া গাড়িখানা ধড়াস্ করিয়া কাদার ভিতর নামিয়া অনেকখানি বসিয়া গেল।
গরু দুটি একবার ডাইনে, একবার বায়ে আঁকিয়াৰ্বাকিয়া অগ্রসর হইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কাদা প্রায় তাহাদের বুক-সই; তাহার ভিতর হইতে পা টানিয়া উঠানো দুষ্কর হইয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ গাড়োয়ানের সহিত একযোগে প্রাণপণে চাকা ঠেলিতে লাগিল। কিন্তু ওপারেও তেমনি খাড়া পাড়, গাড়ি কিছুতেই উঠাইতে পারিল না। গরু দুইটা তো পূর্ব হইতেই ক্লান্ত হইয়াছিল; এক্ষণে ক্রমাগত লেজমলা এবং পাঁচনবাড়ি খাইতে খাইতে মৃতপ্রায় হইয়া সেই কাদার উপরেই শুইয়া পড়িল। গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া উঠিল, হুমুন্দির গরু আবার বজ্যাত্তি লাগাল দ্যাহো! এবং আবার মারিবার জন্য ভীষণ আস্ফালনের সহিত পাঁচনবাড়ি উঠাইল। আবদুল্লাহ্ তাহাকে নিরস্ত করিবার জন্য তাড়াতাড়ি কহিল, আরে কর কী, মরে যাবে যে! আর পারেই-বা কত? মেরো না ওদের, এক কাজ কর। দেখ যদি দুই চার জন লোক পাওয়া যায়। পয়সা দেবখন–যা চায় তাই দেব বলে নিয়ে এসো।
গাড়োয়ান কহিল, এ হেঁইর গাঁ, এহানে কি মুনিষ্যি পাওয়া যাবি? যে গেরামডা এই পাছে থুয়ে আলাম, স্যানে পাওয়া গেলিউ যাতি পারে।
তবে তাই যাও, দেরি কোরো না।
গাড়োয়ান চলিয়া গেল। আবদুল্লাহ্ কাদা ঠেলিয়া উঠিয়া আসিল এবং ছাতাটি খুলিয়া সেই ব্রাহ্মণের দাওয়ার সম্মুখে রাস্তার উপরেই বসিয়া পড়িল।
ব্রাহ্মণটি উঠিয়া গিয়াছিলেন; কিছুক্ষণ পরে পান চিবাইতে চিবাইতে ডাবা হাতে আবার বাহিরে আসিয়া বসিলেন। আবদুল্লাহ্ ঘাড় ফিরাইয়া তাহাকে একবার দেখিয়া লইল, কিন্তু কোনো কথা কহিল না।
এদিকে দ্বিপ্রহর গড়াইয়া গিয়াছে–ক্ষুধায়, শ্রান্তিতে ও উদ্বেগে আবদুল্লাহ্ অস্থির হইয়া উঠিল। গাড়োয়ানের ফিরিতে কত দেরি হইবে, কে জানে? আবদুল্লাহ্ পথের দিকেই চাহিয়া আছে। অবশেষে প্রায় অর্ধঘণ্টা পরে দূর হইতে তিন-চারি জন লোক আসিতেছে দেখা গেল। গাড়োয়ান লোক লইয়া ফিরিতেছে মনে করিয়া আবদুল্লাহর ধড়ে যেন প্রাণ আসিল। ক্রমে তাহারা নিকটবর্তী হইলে আবদুল্লাহ্ দেখিল সে-ই বটে, তিনজন লোক সঙ্গে।