হাশেম পিতার আদেশ পাইয়া দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। তিন-চার জন লোক তখন হাত ধুইয়া ঘরের বাহির হইতেছিল; তাহারা ট্যাক হইতে পয়সা বাহির করিয়া গনিয়া দিয়া গেল। কিন্তু আরো কয়েকজনের নিকট হইতে পয়সা আদায় করা বাকি, তাহারা গেল। কোথায়? হোটেলওয়ালা অবশিষ্ট আহার-নিরত যাত্রীদিগকে ডাল দিতেছিল; সে কহিল, দেখ তো হাশেম, কুয়োটার কাছে, এ মেয়া-সাহেবেরা কেমন লোক? খানা খায়্যা পয়সা না দ্যেই ভাগতি চায়?
যে লোকটি হোটেলওয়ালার সহিত খাদেমি করিতেছিল, সে ইতোমধ্যে একবার বাবুর্চিখানায় যাইবার পথে কুয়ার ধারে জন তিনেক লোক ধরিয়া পয়সা আদায় করিয়া লইয়াছিল। সে ঘরে আসিয়া হোটেলওয়ালাকে কহিল, মেয়া ভাই, এই লন তিন জনের পয়সা।
হাশেম তিন জনের নিকট হইতে পয়সা আদায় করিয়াছিল। হোটেলওয়ালা গনিয়া দেখিল, সাত জন লোক উঠিয়াছে, কিন্তু পয়সা দিয়াছে ছয় জন। কোন্ লোকটা পয়সা না দিয়া পলাইল? হাশেম কহিল, যে মানুষটা শ্যাষে আইস্যা বসছিল, তারে কিন্তু আমি দেহি নাই। হোটেলওয়ালার ভাই কহিল, আমিও তো দেহি নাই! ওই মানুষটাই ভাগছে বোধ করি। মেয়া ভাই, যাই দেহি ইস্টিশনে গ্যে মানুষটারে ধরি। বলিয়াই সে চলিয়া গেল।
এদিকে সকলে খানা শেষ করিয়া উঠিয়াছে, এমন সময়ে গাড়ি আসিল। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই আবার গাড়ি ছাড়িয়া দিল এবং তাহার একটু পরেই হোটেলওয়ালার ভাই ফিরিয়া আসিয়া কহিল, না, তারে তো ধত্তি পাল্লাম না মেয়া ভাই–বড্ড ফাঁকি দ্যে গেল।
হোটেলওয়ালার পক্ষে এরূপ ফাঁকিতে পড়া কিছু নূতন নহে। সেও তেমনি ঘণ্টা না পড়িলে লোককে ভাত দিত না; সুতরাং অনেককেই আধপেটা খাওয়াইয়া পুরা তিনগণ্ডা পয়সা আদায় করিয়া পোষাইয়া লইত। সে কেবল কহিল, ভালো রে ভালো, এমন মুসল্লি মানুষটা। ওই যে কয়, বোলে মানুষির মাথায় কালো চুল, মানুষ চেনা ভার। তা সত্যি!
প্রাতে একখানি গাড়ি ঠিক করিয়া আবদুল্লাহ্ রওয়ানা হইল। তখন কার্তিক মাস; বর্ষাকাল শেষ হইয়া গেলেও এখনো তাহার জের মিটে নাই। রাস্তার স্থানে স্থানে অনেকটা কাদা জমিয়া আছে; কাজেই গাড়ি অত্যন্ত মন্থর গতিতে চলিতে লাগিল।
এইরূপে মাঠ পার হইয়া গ্রামের ভিতর এবং গ্রাম পার হইয়া মাঠের ভিতর দিয়া। আবদুল্লাহর গাড়িখানি চলিতে লাগিল। ক্রমে বেলা দ্বিপ্রহর হইয়া আসিল দেখিয়া আবদুল্লাহ গাড়োয়ানকে কহিল, একটা বাজার-টাজার দেখিয়া গাড়ি থামানো হউক, কিছু নাশতা করিয়া লওয়া যাইবে।
গাড়োয়ান কহিল, হুমকির এই গেরামড়ার ওই মুড়োয় বাজার আছে, কাছে এট্টা ভালো পুষ্কর্নিউ আছে, পানি-টানি খাতি পারবেন।
আবদুল্লাহ কহিল, আচ্ছা তাই চল।
যে রাস্তা দিয়া আবদুল্লাহর গাড়ি চলিতেছিল, সেটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। রাস্তাটি বেশ চওড়া ও উচ্চ; কিন্তু সম্মুখস্থ গ্রামের ভিতর দিয়া না গিয়া বাকিয়া গ্রামের বাহির দিয়া গিয়াছে। উহার দক্ষিণ পার্শ্বে গ্রাম এবং বাম পার্শ্বে বিল। গাড়োয়ান কহিল, এ সরকারি রাস্তা দিয়া আর যাওয়া যাইবে না, কারণ বিলের ভিতর খানিকটা রাস্তা নাই, জলে একদম ধুইয়া গিয়াছে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কায়দাই এরূপ, এক বর্ষায় রাস্তা ভাঙে, আর এক বর্ষার প্রারম্ভে মেরামত হয়। সুতরাং গ্রামের ভিতরকার সঙ্কীর্ণ পথ দিয়াই যাইতে হইবে।
গ্রামের মধ্য দিয়াই গাড়ি চলিল। পথের উভয় পার্শ্বে ঘন বসতিঘরগুলির বারান্দা। একেবারে রাস্তারই উপর। পথ এত সঙ্কীর্ণ যে একখানি গাড়ি চলিলে আর মানুষ পর্যন্ত চলিবার স্থান থাকে না। খানিকদূর গিয়াই আবদুল্লাহ্ দেখিল, সর্বনাশ! এ রাস্তাও খানিকটা ভাঙা, মধ্যে ভয়ানক গর্ত, জল-কাদায় ভরা। ভাঙন অধিক দূর লইয়া নহে, এই হাত পাঁচ-ছয় হইবে। কিন্তু পাড় এমন খাড়া যে, গাড়ি তাহার ভিতর নামানো কঠিন না হইলেও ওঠানো একরূপ অসম্ভব। এক্ষণে উপায়?
গাড়োয়ান কহিল, হুজুর, দেখতিছেন কী? এ হা্বোড়ের মদ্দি দ্যে তো গাড়ি চলবি নে।
তবে কী করা যায়?
গাড়োয়ান একটু ভাবিয়া কহিল, দেহি যদি আর কোনো পথ পাই।
গাড়িখানি ভাঙা রাস্তার কিনারায় দাঁড় করাইয়া রাখিয়া গাড়োয়ান পাড়ার মধ্যে প্রবেশ করিল। আবদুল্লাহ্ গাড়ি হইতে নামিল। সম্মুখে রাস্তার উপরেই একখানি বাড়ি; তাহার দাওয়ায় এক ব্রাহ্মণ খালি গায়ে বসিয়া ডাবা হুঁকায় তামাক খাইতেছিলেন। আবদুল্লাহ্ একটু
অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, মশায়, গাড়ি যাবার কি আর কোনো পথ আছে?
ব্রাহ্মণটি একটু ঘাড় নাড়িয়া একটি উঁহুক শব্দ করিয়া ধোঁয়া ছাড়িলেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, তবে কী করি, মশায়, বড়ই মুশকিল হল তো!
ব্রাহ্মণটি কোনো উত্তর করিলেন না। রৌদ্রতাপে ক্লান্ত হইয়া আবদুল্লাহর বড়ই ইচ্ছা হইতেছিল, দাওয়ার উপর উঠিয়া বসিয়া একটু বিশ্রাম করে, কিন্তু গৃহস্বামীর দুজ্ঞেয় তুষ্ণীভাব দেখিয়া আর তাহার সাহস হইল না। অগত্যা সে রাস্তার পার্শ্বেই ছাতা খুলিয়া বসিয়া ব্যগ্রচিত্তে গাড়োয়ানের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে গাড়োয়ান ফিরিয়া আসিয়া কহিল, হুজুর, আছে এট্টা পথ; কিন্তু সে এক ঠাহুরির বাড়ির পর দ্যে যাতি হয়। আপনি গে তানারে এট্টু করে বুলে দ্যাহেন যদি যাতি দেন।