স্টেশনের বাহিরেই কয়েকটা হোটেল আছে। আবদুল্লাহ্ তাহারই একটাতে গিয়া উঠিল। সঙ্গে জিনিসপত্র বেশি ছিল না, একটা তোরঙ্গ, একটা বিছানার মোট আর একটা বদনা। হাত-মুখ ধুইবার জন্য জল চাহিলে হোটেলওয়ালা একটা কুয়া দেখাইয়া দিল। আবদুল্লাহ বদনাটা লইয়া কুয়ার নিকটে গেল এবং এক বালতি জল উঠাইয়া বদনা ভরিয়া জল আনিয়া বারান্দার এক প্রান্তে ওযু করিতে বসিল। হোটেলে আরো অনেক যাত্রী ছিল; আবদুল্লাহকে ওযু করিতে দেখিয়া তাহাদের মধ্য হইতে কয়েকজন উঠিয়া ওযু করিবার জন্য কুয়ার ধারে গেল। ইতোমধ্যে আবদুল্লাহ্ ওযু সারিয়া জায়নামাজ বাহির করিল এবং হোটেল ঘরটির এক কোণে গিয়া নামাযে খাড়া হইল, ক্রমে আরো দুই-চারি জন যাত্রী ওযু করিয়া আসিয়া, কেহ তাহার দক্ষিণ পার্শ্বে, কেহ পশ্চাতে, কেহ উড়ানী, কেহ স্কন্ধস্থিত রঙিন রুমাল বিছাইয়া, নামাযে যোগদান করিল।
নামায শেষ হইতে না হইতেই খানা আসিল। প্রথমে একটা শতছিন্ন লম্বা মাদুর মেঝের উপর পাতা হইল, তাহার উপর, মাদুরের অর্ধেক ঢাকিয়া একটা খেরুয়ার দস্তরখান বিছাইয়া দিল। দস্তরখানটিতে যে কয় বেলার ডাল, সুরুয়া, ঘুসা-চিংড়ির খোসা, মাছের দুই-একটা সরু কাটা ইত্যাদি শুকাইয়া লাগিয়া রহিয়াছে, তাহার ঠিকানা নাই।
নামায শেষ করিয়া উঠিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিল, দুই-চারি জন যাত্রী খানার প্রত্যাশায় দস্তরখানে বসিয়া আছে। সেও আসিল, পার্শ্বে চিলমচি ও বদনা ছিল, হাত ধুইয়া লইল; মাদুরের কোন্খানটিতে বসিলে মাটি লাগিয়া কাপড় নষ্ট হইবে না, তাহা খুঁজিয়া পাইল না। অবশেষে মাটি-মাদুর নির্বিশেষে এক প্রান্তে তাহাকে বসিয়া পড়িতে হইল। দস্তরখানটির দুর্গন্ধে আবদুল্লাহ্ মনে মনে বিরক্ত হইল বটে, কিন্তু এরূপ দস্তরখানে বসা তাহার পক্ষে নূতন নহে–সচরাচর বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খাইতে গিয়া সে দস্তরখানের দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। দরিদ্র মুসলমান ভদ্রলোকেরা পৈতৃক ঠাঁট বজায় রাখিতেই চেষ্টা করিয়া থাকেন; কিন্তু মানসিক নিশ্চেষ্টতার দরুন পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করিয়া চলিবার তৎপরতাটুকু তাহারা হারাইয়া বসিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় বেচারা হোটেলওয়ালার আর অপরাধ কী!
ওদিকে যাহারা নামাযে শরিক হইয়াছিল, তাহাদের মধ্য হইতে একে একে সকলে আসিতে লাগিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি লোক টিকিয়া গেল–এদিকে সকলের খানা শুরু হইয়া গিয়াছে, কিন্তু সে লোকটি ঘাড় গুঁজিয়া তাহার রঙিন রুমালটির উপর বসিয়াই রহিল। হোটেলওয়ালা তাড়া দিয়া কহিল, নেও নেও মেয়াসাহেব, ওঠ, উদিক দে গাড়ি আস্যে পড়ল বুঝি। ওই শোন ঘণ্টা পড়তিছে।
বাস্তবিকই স্টেশনে ঘণ্টা পড়িতেছিল; কিন্তু উহা গাড়ি আসিবার ঘণ্টা নহে, রাত্রি দশটার ঘণ্টা। কিন্তু তাহা হইলেও গাড়ির ঘণ্টা পড়িবার আর বড় বিলম্ব ছিল না। বরিহাটী যাইবার গাড়ি সাড়ে দশটায় বিলগায় আসিবে। লোকটা হোটেলওয়ালার তাড়া খাইয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা শুনিয়া ঝটপট মোনাজাত করিয়া উঠিয়া পড়িল এবং দেও, দেও, জলদি খানা দেও বলিতে বলিতে দস্তরখানে আসিয়া বসিল।
হোটেলওয়ালা একটা বড় কাঠের খাঞ্চা ভরিয়া ভাত আনিল এবং কলাই-চটা এনামেলের রেকাবিগুলিতে দুই-তিন থাবা করিয়া ভাত দিয়া গেল। আর একটি লোক সবুজ রঙের লতাপাতা কাটা একটা বড় চিনামাটির পেয়ালা হইতে বেগুন ও ঘুসা-চিংড়ির ঘণ্টা থপথপ্ করিয়া খানিকটা খানিকটা দিয়া যাইতে লাগিল। একটা লোক বলিয়া উঠিল, কই মেয়াসাহেব, একটু নেমক দিলে না?
ওরে হাশেম, নেমক দিয়ে যা রে– বলিয়া হোটেলওয়ালা এক হাঁক দিল। হাশেম নামক ছোকরাটি দৌড়িয়া বাবুর্চিখানার দিকে গেল, কিন্তু একটু পরেই ফিরিয়া আসিয়া কহিল, নেমক তো নেই, বাপজী।
বলিস্ কী রে! নেমক নেই? দৌড়ে যা, দৌড়ে যা, বাজারতে এক পয়সার নেমক নে আয় বলিয়া হোটেলওয়ালা কাপড়ের খুঁট খুলিয়া একটা পয়সা বাহির করিয়া দিল। এ কার্যে অবশ্য তাহার আর হাত ধুইবার কোনো আবশ্যকতা দেখা গেল না।
এদিকে যাত্রীদিগের মধ্যে অনেকে বিনা লবণেই বিসমিল্লাহ্ বলিয়া খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল; কিন্তু সেই অতি-নামাযী লোকটি এবং তাহার দেখাদেখি আরো দুই-এক জন কাঁধে রঙিন রুমালওয়ালা লবণ অভাবে বিসমিল্লাহ্ করিতে না পারিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া রহিল। প্রায় আট-দশ মিনিট পরে ছোকরাটি লবণ লইয়া ফিরিয়া আসিল এবং কাগজের ঠোঙা হইতে একটু একটু লবণ তুলিয়া পাতে পাতে দিয়া গেল। তখন রঙিন রুমালওয়ালা একটু নড়িয়া বসিয়া একটু কাশিয়া, তর্জনীটি একবার লবণের উপর চাপিয়া লইয়া সাড়ম্বরে বিসমিল্লাহ্ বলিয়া উহা জিহ্বাগ্রে ঠেকাইয়া, খানা আরম্ভ করিল।
বেগুনের সালুন দিয়া খাওয়া প্রায় শেষ হইল, যাত্রীরা ডাল এবং আরো চারিটি ভাত চাহিতেছে, এমন সময় স্টেশনে ঢং ঢং করিয়া ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। হোটেলওয়ালা কহিল, জলদি খায়্যা লেন মেয়াসাহেবেরা, গাড়ি আস্যে পড়ল।
এ্যাঁ, খাওয়াই যে হল না! কী করি? বলিতে বলিতে পাঁচ-সাত জন উঠিয়া পড়িল। তাড়াতাড়ি হাত ধুইবার জন্য বদনা লইয়া কাড়াকাড়ি পড়িয়া গেল–কেহ-বা কুয়ার দিকে ছুটিল। হোটেলওয়ালা চিৎকার করিয়া কহিল, পয়সা তিন আনার দে যাবেন মেয়া সাহেবরা। ওরে হাশেম, পয়সাডা গুনে নিস…