যাহা হউক, আবদুল্লাহর এই সৌভাগ্যে আকবর আলী এবং আবদুল কাদের, এই দুই জন আন্তরিক সুখী হইলেন, এবং বারবার খোদার নিকট শোকর করিতে লাগিলেন। আকবর আলী কহিলেন, দেখুন খোনকার সাহেব, আপনার মুখের উপর বলাটা যদিও ঠিক নয়, তবু বলি যে, যোগ্য লোকের উন্নতি খোদা যে কোন দিক থেকে জুটিয়ে দেন, তা বলা যায় না। বাস্তবিক এখানে যার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে, সকলেই আপনার প্রশংসা করে। বিশেষ আপনার খোশ-আখলাকে সকলেই মুগ্ধ। আপনি যাচ্ছেন বটে, খোদা করুন দিন দিন আপনার উন্নতি হোক–কিন্তু আমাদের আপনি কাঁদিয়ে যাচ্ছেন।
আবদুল্লাহ্ আজ্রকণ্ঠে কহিল, মুন্সী সাহেব, আপনি আমাকে বড্ড বেশি স্নেহ করেন বলেই এসব বলছেন…
আবদুল কাদের রহস্য করিয়া কহিল, নেও নেও; উনি স্নেহ করেন, আর আমি বুঝি করি নে? আমি কিন্তু ওয়াদা কচ্ছি, তুমি চলে গেলে এখানকার কেউ তোমার জন্য কাঁদবে না–আমিও না…
বলিতে গিয়া সত্য সত্যই আবদুল কাদেরের দুই চোখ ভরিয়া উঠিল। আবদুল্লাহ্ তাহাকে বক্ষের উপর টানিয়া ধরিয়া রুদ্ধকণ্ঠে কহিতে লাগিল, ভাই, প্রথম চাকরি পেয়ে অবধি আমরা দুজনে এক জায়গাতেই ছিলাম–বড়ই আনন্দে ছিলাম। এখন প্রমোশন পেলাম। বটে, কিন্তু তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে, এই কথা মনে করে প্রাণটা অস্থির হচ্ছে। এ আড়াইটা বছর কী নির্ভাবনায়, কী আনন্দেই কেটে গেছে! বুঝি জীবনের এই কটা দিনই শ্রেষ্ঠ দিন গেল, এমন সুখের দিন আর হবে না, ভাই!
সন্ধ্যার কিছু পরে যখন আবদুল্লাহ্ বোর্ডিঙে ফিরিয়া আসিল, তখন দেখিল, স্কুলের অনেকগুলি ছাত্র সেখানে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। তাহাকে আসিতে দেখিয়া সেকেন্ড ক্লাসের ছাত্র সতীশ অগ্রসর হইয়া নমস্কার করিল এবং কহিল, স্যার, আপনি হেডমাস্টার হয়ে চলে যাচ্ছেন, তাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি; কিন্তু আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন বলে মনে বড় দুঃখ হচ্চে। তা আমরা আপনাকে একটা address দেব বলে হেডমাস্টার মহায়শকে বললাম, কিন্তু তিনি বললেন, ওটা নাকি rule-এর against-এ। এখন আপনি যদি বলেন, তবে অন্য কোনো জায়গায় মিটিং করে আপনাকে address দিই।
আবদুল্লাহ্ কহিল, না হে, যখন ওটা rule-এর against-এ তখন ওসবে কাজ নেই। তোমরা সকলে যে আজ আমার সঙ্গে এখানে দেখা কত্তে এসেছ, এতেই address-এর চাইতে আমাকে ঢের বেশি সম্মান করা হয়েছে।
অবনী নামক আর একটি ছাত্র নিরাশাব্যঞ্জক স্বরে কহিল, তবে কি স্যার, আমাদের address দেওয়া হবে না?
এই তো দিচ্ছ ভাই আমাকে address! সভা করে ধুমধাম না কলে কি আর মনের ভালবাসা জানানো হয় না? আজ সত্যিই আমি বুঝতে পাচ্ছি, তোমরা আমাকে কতখানি ভালবাস! এই বেশ; আমার সঙ্গে তোমাদের কেমন ভাব, লোকে তা নাই-বা জানল! শুধু তোমরা আর আমি জানলাম। এই বেশ।
আবদুল্লাহর কথাগুলি ছাত্রদের মর্মে গিয়া স্পর্শ করিল-–কয়েকজন আবেগভরে বলিয়া উঠিল, থাক, স্যার, address দিতে চাই নে–তবে ভগবান করুন যেন আপনি শিগগিরই আমাদের হেডমাস্টার হয়ে আসেন।
আবদুল্লাহ্ হাসিয়া কহিল, দেখ, পাগলগুলো বলে কী! কেন, আমাদের হেডমাস্টার তো চমৎকার লোক। তিনিই ইনস্পেক্টার সাহেবের কাছে আমার জন্যে সুপারিশ করে এই চাকরি করে দিয়েছেন, এমন লোককে কি অশ্রদ্ধা কত্তে হয়!
তা হোক স্যার, আপনি গেলে আপনার মতো স্যার আমরা আর পাব না।
দেখ, তোমরা আমাকে ভালবাস বলেই এমন কথা বলছ। আমার মতো শিক্ষক পাও আর না পাও–আশীর্বাদ করি যেন আমার অপেক্ষা শত সহস্রগুণ ভালো শিক্ষক তোমরা পাও।–কিন্তু তোমাদের কথাবার্তা শুনে আমি যে বুঝতে পাচ্ছি আমি তোমাদের ভালবাসা লাভ কত্তে পেরেছি, এতেই আমার মনে যে কত আনন্দ হচ্ছে, তা বলে শেষ করা যায় না। আশীর্বাদ করি, তোমরা মানুষ হও, প্রকৃত মানুষ হও–যে মানুষ হলে পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা কত্তে ভুলে যায়, হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে আপনার জন বলে মনে কত্তে পারে। এই কথাটুকু তোমরা মনে রাখবে ভাই, –অনেকবার তোমাদের বলেছি, আবার বলি, হিন্দু মুসলমান ভেদজ্ঞান মনে স্থান দিও না। আমাদের দেশের যত অকল্যাণ, যত দুঃখকষ্ট, এই ভেদজ্ঞানের দরুনই সব। এইটুকু ঘুচে গেলে আমরা মানুষ হতে পারব– দেশের মুখ উজ্জ্বল কত্তে পারব।
এইরূপ কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়া মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া আবদুল্লাহ্ সকলকে বিদায় দিল। যাইবার পূর্বে তাহারা জানিয়া গেল যে, আগামীকল্যই আবদুল্লাহ স্কুলের কাজ হইতে অবকাশ লইবেন এবং পরশু শুক্রবার বাদজুমা বিকালের ট্রেনে রওয়ানা হইবেন।
কিন্তু রওয়ানা হইবার সময় স্টেশনে ছাত্রদের কেহই আসিল না। আবদুল্লাহ্ মনে করিয়াছিল, তাহাকে বিদায় দিবার জন্য দুই-চারি জন ছাত্র নিশ্চয়ই স্টেশনে আসিবে, তাই প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়াইয়া উৎসুক নেত্রে এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিল। শেষ ঘণ্টা পড়িল, তবু কেহ আসিল না। আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি আকবর আলী এবং আবদুল কাদেরের সহিত কোলাকুলি করিয়া গাড়িতে চড়িয়া বসিল।
গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
.
২৯.
রাত্রি প্রায় ৯টার সময় বিলগাঁ স্টেশনে গাড়ি থামিল। আবদুল্লাহ জিনিসপত্র লইয়া নামিয়া পড়িল। এইখান হইতে গরুর গাড়ি করিয়া তাহাকে অনেকটা পথ যাইতে হইবে। রাত্রে গাড়িতে যাওয়া যাইবে না–একটা হোটেলে থাকিতে হইবে; পরদিন প্রাতে গাড়ি ছাড়িলে সন্ধ্যার পূর্বেই রসুলপুর পৌঁছিতে পারিবে।