তাহাকে দেখিয়াই হেডমাস্টার স্মিতমুখে, গুড় নিউজ ফর ইউ, মৌলভী, লেটু মি কগ্রাচুলেট ইউ! বলিয়া আবদুল্লাহর হাতখানি ধরিয়া প্রবলবেগে দুই-তিনটা ঝকা দিয়া দিলেন।
আবদুল্লাহর বুকের ভিতর টিপটিপ করিতে লাগিল। সে ঔৎসুক্যে অধীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কী, স্যার?
হেডমাস্টার কহিলেন, কবে খাওয়াচ্ছেন তা আগে বলুন, –খোশ-খবর কি অম্নি অনি বলা যায়?
বেশ তো, যদি এমনই খোশ-খবর হয় তা হলে খাওয়াব বৈকি! অবিশ্যি আমার সাধ্যে যদ্র কুলোয়।
তা আর কুলোবে না? বলেন কী! যে খবর দিচ্ছি, তার দাম নেমন্তন্ন খাওয়ার চাইতে অনেক বেশি। আচ্ছা আপনি আঁচ করুন দেখি, এমন কী খবর হতে পারে?
সংবাদটি জানিবার জন্য আবদুল্লাহর প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল–অতি কষ্টে ঔৎসুক্য দমন করিয়া কহিল, বোধ করি একটা প্রমোশন পেয়ে থাকব।
হেডমাস্টার অবজ্ঞাভরে কহিলেন, না, আপনার সাধ্যই নেই সে আসল কথাটা আঁচ করা। যদি বলি আপনি হেডমাস্টার হয়েছেন, বিশ্বাস করবেন?
কোথাকার হেডমাস্টার?
রসুলপুর হাইস্কুলের।
রসুলপুরের! আমি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখুন ইনস্পেক্টরের চিঠি। ও স্কুলটা যে এখন প্রভিন্সিয়ালাইজড় হয়ে গেল। আপনাকে সত্বর রিলিভ করবার জন্যেও কড়া হুকুম এসেছে!
আবদুল্লাহ্ কম্পিতহস্তে পত্রখানি লইল এবং তাড়াতাড়ি তাহার উপর দিয়া চোখ বুলাইয়া গেল। সত্যই তো তাহাকে রসুলপুরের নূতন গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের হেডমাস্টার নিযুক্ত করা হইয়াছে।–একশত টাকা বেতন। তৎক্ষণাৎ ইনস্পেক্টর সাহেবের শেষ কথা কয়টি তাহার মনে পড়িয়া গেল, আপনার যাতে সুবিধে হয়ে যায়, তার জন্য আমি চেষ্টা করব এবং কৃতজ্ঞতায় তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। পত্রখানি হেডমাস্টারকে ফিরাইয়া দিয়া সে গদগদকণ্ঠে কহিল, স্যার, এ কেবল আপনার সুনজর ছিল বলে…
হেডমাস্টার যথেষ্ট গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া কহিলেন, সাহেব সেদিন ইনস্পেকশনের সময় আমাকে বলেছিলেন, রসুলপুর স্কুল প্রভিন্সিয়ালাইজড় হবে, আর সেখানে একজন ভালো হেডমাস্টার নিযুক্ত করা হবে। আমি তক্ষনি তাকে বললাম, আমার স্টাফে একজন খুব উপযুক্ত লোক আছেন। বুঝতেই পাচ্ছেন, আপনার কথাই আমি তাকে বলেছিলাম–তা তিনি আপনার নাম নোট করে নিয়েছিলেন। আচ্ছা, আপনাকে কোনো হিন্দু দেন নি?
না, স্যার। আমি স্কুলে একজন মৌলবী দেবার কথা বলতে গিয়েছিলাম, অন্য কোনো কথা হয় নি তো।
বড়ই আশ্চর্য! সাহেবের এ্যাটিচুড দেখে কিন্তু আমার তখনই মনে হয়েছিল যে, আপনাকেই সিলেক্ট করবেন–আর করেছেন তাই। যা হোক, আমার রেকমেন্ডেশনটা যে তিনি রেখেছেন, এতে আজ আমার ভারি আনন্দ হচ্চে, মৌলবী সাহেব!
আবদুল্লাহ্ বিনয়ের সাথে কহিল, আপনার অনুগ্রহ!
তা হলে আপনি কবে যাচ্ছেন?
যখন আপনার সুবিধে হবে…
আমার সুবিধের তো কথা হচ্ছে না–মৌলবী সাহেব, আপনাকে এ্যাটওয়ান্স রিলি করবার জন্যে যে অর্ডার আছে। বিলম্ব করা তো আপনার পক্ষে উচিত হবে না।
তবে কবে আমাকে রিলিভ করবেন?
বলেন তো কালই।
আচ্ছা, স্যার।
কিন্তু আপনি যত শিগগির পারেন, ওখানে গিয়ে জয়েন করবেন। যেতেও তো দিন দুই লাগবে–কমুনিকেশন ওখানকার বড়ই বিশ্রী। আপনি আজই গিয়ে সব গুছিয়েটুছিয়ে নিন।…
আবদুল্লাহ্ একটু ভাবিয়া কহিল, তা হলে হোস্টেলের চার্জ কাকে দেব?
হেডমাস্টার যেন একটু চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, ওঃ হো! সে কথা তো আমি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছি। এই জানুয়ারি থেকে একজন মৌলবী আসচেন যে!
আবদুল্লাহ্ একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, অর্ডার এসেচে নাকি?
ইনস্পেক্টর সাহেব যে একেবারে এতখানি অনুগ্রহ করিয়া ফেলিবেন, ইহা স্বপ্নেরও অতীত। যাহা হউক, নিজের পদোন্নতিতে তো আবদুল্লাহ্ সুখী হইলই, তাহার ওপর মৌলবী নিযুক্ত করা সম্বন্ধে যে তাহার অনুরোধ রক্ষা করা হইয়াছে, ইহাতেও সে যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ লাভ করিল।
দেখিতে দেখিতে স্কুলময় এই আশ্চর্য সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া গেল। যে যে ঘণ্টায় যাহাদের বিশ্রাম, তখন তাহারা নানাপ্রকারে ইহার সমালোচনা করিতে লাগিলেন। কোথায় কোন স্কুলে কজন বিশেষ বিশেষ যোগ্য লোক আছেন, বরিহাটীর স্টাফেও আবদুল্লাহ্ অপেক্ষা সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ কে কে আছেন, একে একে তাঁহাদের নাম হইতে লাগিল, এবং সকলেই একবাক্যে মত প্রকাশ করিলেন যে, এ লোকটা কেবল মুসলমান বলিয়াই হঠাৎ এমন বড় চাকরিটা পাইয়া গেল। ইহাও সকলে স্থির করিয়া ফেলিলেন যে, ও স্কুলের হেডমাস্টারি করা আবদুল্লাহর কর্ম নয়; দুদিনের মধ্যেই একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটিয়া যাইবেই যাইবে।
আবার কেহ কেহ কহিলেন, মুসলমানের আজকাল সাতখুন মাপ। আবদুল্লাহর আমলে স্কুলটি গোল্লা-নামধেয় স্থানবিশেষের প্রতি দুর্জয় ঝোঁক দেখাইলেও তাহার কোনো ভয়ের কারণ নাই। রসুলপুরের ভূতপূর্ব হেডমাস্টার বরদাবাবু কী-ই বা অপরাধ করিয়াছিলেন– কতকগুলো দুষ্ট ছেলে একটা কাণ্ড করিল, আর তাহার জন্য কিনা বেচারা বরদাবাবুর চাকরিটাই গেল। বরদাবাবু যদি মুসলমান হইতেন, তাহা হইলে স্কুলে স্বদেশীর হাট বসাইলেও গভর্নমেন্ট তাহাকে একটা খা বাহাদুরি না দিয়া ছাড়িতেন না। আর পড়াশুনা? আপনারা পাঁচজনে দেখিয়া লইবেন, যদি সাত বৎসরেও একটি ছেলে রসুলপুর হইতে এনট্রান্স পাস না করে, তথাপি আবদুল্লাহর প্রমোশন স্থগিত থাকিবে না।