সুফী সাহেব লোকটি বেশ ভোজনবিলাসী। দুই-এক লোকমা পোলাও খাইয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, ওঃ বড়া ওদা খানা পাক্কা! কাবাব ভি বহোৎ জায়েকাদার হুয়া!
ডাক্তারবাবু কহিলেন, বাস্তবিক, রান্নাটা খাসা হয়েছে কিন্তু। আমি অনেক জায়গায় খেয়েছি, কিন্তু এমনটি কোথাও খাই নি।
সামু খাইতে খাইতে জল চাহিল। সলিম এক গ্লাস জল ঢালিয়া তাহার হাতে দিল। কয়েক চুমুক খাইয়া সামু গেলাসটি দস্তরখানের উপর রাখিল। সুফী সাহেব চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, বাড়া বে-তামিজ লাড়কা! দস্তরখান পর পানি কা গিলাস রাখতা হায়।
আবদুল খালেক কহিল, সামু, গেলাসটা তুলে সলিমের হাতে দাও বাবা।
খানা চলিতে লাগিল। আবদুল্লাহ কোরমার পেয়ালাটি বাম হস্তে তুলিয়া আনিয়া কাছে রাখিল এবং বাম হস্তে চামচ ধরিয়া কয়েকজনকে কোরমা তুলিয়া দিয়া, পেয়ালাটি আবদুল কাদেরের দিকে বাড়াইয়া দিয়া কহিল, দাও তো ভাই ওদিকে…ডাক্তারবাবুদের পাতে বেশি করে দিও!
দেবনাথবাবু আপত্তি করিয়া কহিলেন, ঢের রয়েছে যে, কত আর খাব! কিন্তু বলিতে বলিতেই দুই-তিন চামচ করিয়া কোরমা তাহাদের পাতে পড়িয়া গেল।
সুফী সাহেব কহিলেন, লাইয়ে তো পিয়ালা ইধার, নরম, এক বোটি চুন্ লে। আবদুল কাদের কোরমার পেয়ালা তাহার দিকে বাড়াইয়া দিল। সুফী সাহেব পেয়ালার ভিতর দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলি ডুবাইয়া দিয়া মাংসের টুকরা টিপিয়া টিপিয়া কয়েকখানি বাছিয়া তুলিয়া লইলেন।
আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি সলিমকে ডাকিয়া কানে কানে কহিয়া দিল, দৌড়ে আর একটা পেয়ালায় করে কোরমা নিয়ে আয় তো! আর একটা চামচও আনি।
সলিম দরজার কাছে গিয়া মামাকে ডাকিয়া কহিতেই সে আর এক পেয়ালা কোরমা চামচসহ আনিয়া দিল।–সলিম উহা লইয়া ভিতরে আসিলে আবদুল্লাহ্ তাহাকে কহিল, ওটা ডাক্তারবাবুদের সুমুখে রেখে দে।
কিছুক্ষণ পূর্বে সুফী সাহেব জল খাইয়া গেলাসটি কাছেই রাখিয়া দিয়াছিলেন। এক্ষণে আবার জলের আবশ্যক হওয়াতে তিনি গেলাসটি উঠাইয়া সলিমের হাতে দিয়া কহিলেন, পানি দেও।
গেলাসের তলায় সামান্য একটু জল ছিল, সলিম তাহাতেই আবার জল ঢালিয়া দিল। সুফী সাহেব চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, জুঠা পানিমে পানি ডালতা হায়? ফেঁক দেও উওহ পানি।
সলিম সে জল ফেলিয়া দিয়া আবার এক গ্লাস ঢালিয়া দিল।
সামু আবদুল্লাহর পাশেই বসিয়াছিল। সে ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ফুপাজান, জুঠা পানিতে পানি ঢাললেই দোষ, আর ভরা পিয়ালায় জুঠা হাত ডুবালে দোষ হয় না?
আবদুল্লাহ্ কহিল, চুপ, ওকথা এখন থাক্।
ক্রমে আহার শেষ হইল। তাহার পর হাত ধুইবার পালা। সলিম চিলমচি, বদনা, তোয়ালে প্রভৃতি লইয়া আসিল। ডাক্তারবাবুদেরই আগে হাত ধোয়ানো হইল। তাহারা সাবান দিয়া হাত ধুইলেন। তাহার পর মৌলবী সাহেব, তিনিও সাবান লইলেন। কিন্তু বিলাতি সাবানে হারাম বস্তু থাকা সম্ভব মনে করিয়া সুফী সাহেব তাহা স্পর্শ করিলেন না; কেবল জল দিয়া হাত ধুইয়াই–খ্যাক–থু করিতে করিতে বেশ করিয়া তোয়ালে দিয়া মুছিয়া ফেলিলেন। হাতের আঙুলে যত চর্বি, ঘি প্রভৃতি জড়াইয়া ছিল, তাহাতে তোয়ালেখানি সুন্দর বাসন্তী রঙে রঞ্জিত হইয়া গেল! আবদুল্লাহ্ বাড়ির ভিতর গিয়া তাড়াতাড়ি আর একখানি পরিষ্কার তোয়ালে লইয়া আসিল।
পান আসিল এবং সঙ্গে সঙ্গে আবদুল কাদের দশ টাকার করিয়া পাঁচখানি নোট আনিয়া দেবনাথবাবুর সম্মুখে রাখিয়া দিল।
ডাক্তারবাবু একটু আশ্চর্য বোধ করিয়া কহিলেন, ও কী?
আবদুল কাদের কহিল, আপনার ভিজিট বাবদ আমরা এতদিন কিছু দিতে পারি নি, ডাক্তারবাবু। তা ছাড়া আপনি আরো যে উপকার করেছেন, তার তো কোনো তো মূল্যই হয় না। তবে মেহেরবানি করে যদি এটা অন্তত সামান্য নজর বলে কবুল করেন…
ডাক্তারবাবু কহিলেন, না, না; ওসব আবার কী! আমি তো এখানে ডাক্তার বলে আসিনে, বন্ধুভাবেই এসেছি। আর আপনারা তো ধওে গেলে হসপিটালেই আছেন–আমার বাড়িতে জায়গা ছিল, তাই ওয়ার্ডে না রেখে এইখেনেই রেখেছি…
তা হোক, হসপিটালই হোক আর যাই হোক, আমরা আপনার কাছে যে কতদূর ঋণী তা এক ঈশ্বর জানেন, আর আমরা জানি। এ সামান্য নজরটা অবশ্য সে ঋণের পরিশোধ হতেই পারে না–তবে আমার সাধ্যে যেটুকু কুলোয় তাই দিচ্ছি, ওটা আপনাকে নিতেই হবে।
ডাক্তারবাবু একটু ভাবিয়া কহিলেন, না নিলে পাছে আপনারা বেজার হন, তাই নিচ্ছি–কিন্তু আর না… বলিয়া তিনি দুখানি নোট উঠাইয়া লইলেন। কিছুতেই অধিক লইতে চাহিলেন না।
এমন সময়, ম্যা সাএব শ্যালাম, শ্যালাম বলিতে বলিতে, এবং সুদীর্ঘ হাতখানি সম্মুখের দিকে হঠাৎ বাড়াইয়া দিয়া আবার টানিয়া লইয়া কপালে ঠেকাইতে ঠেকাইতে, নিকারিপাড়ার মোড়ল আসিয়া ঘরে ঢুকিল।
.
২৮.
২৮ স্কুল খুলিবার কয়েক দিন পরে আবদুল্লাহ্ একদিন ক্লাসে পড়াইতেছে, এমন সময় হেডমাস্টার তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ক্লাসে কাজ করিবার সময় এমন করিয়া হঠাৎ ডাকিয়া পাঠানো স্কুলের রীতিবিরুদ্ধ–তবে কোনো বিশেষ জরুরি কারণ থাকিলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু সে জরুরি কারণটি এক্ষেত্রে কী? কিছু একটা গুরুতর অপরাধ হইয়া গিয়াছে, না কোনো অপ্রত্যাশিত শুভ সংবাদ আসিয়াছে? এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে স্পন্দিত হৃদয়ে আবদুল্লাহ্ হেডমাস্টারের কামরায় গিয়া প্রবেশ করিল।