একটা কাজ কল্লে হয় না, বাবা?
আবদুল্লাহ্ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, কী কাজ আম্মা?
একবার মুরীদানে গেলে হয় না? তারা কি কিছু সাহায্য করবে না তোর পড়াশুনার জন্যে?
মাতা জানিতেন, আবদুল্লাহ্ খোন্দকারী ব্যবসায়ের ওপর অত্যন্ত নারাজ; তবু যদি এই দুঃসময়ে তাহার মন একটু নরম হয়, এই মনে করিয়া তিনি একটু ভয়ে ভয়েই মুরীদানে যাইবার কথা তুলিলেন, কিন্তু তিনি যাহা ভয় করিয়াছিলেন, তাহাই হইল; আবদুল্লাহ্ একটু চঞ্চল হইয়া বলিয়া উঠিল, না আম্মা সে আমাকে দিয়ে হবে না!
মাতা নীরব হইলেন। আবদুল্লাহ্ দেখিল, সে তাহার মাতার মনে বেশ একটু আঘাত দিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু সে যখন নিজের বিশ্বাস ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিতে প্রস্তুত নহে, তখন তাহার মতের সমর্থন করিয়া মাতাকে একটু বুঝাইবার জন্য কহিতে লাগিল, আব্বাও ও-কাজটা বড় পছন্দ করতেন না; তবে আর উপায় ছিল না বলেই তিনি নিতান্ত অনিচ্ছায় মুরীদানে যেতেন। সেই জন্যই তো আমাকে তিনি ইংরেজি পড়তে দিয়েছিলেন, যাতে ও ভিক্ষের ব্যবসায়টা আর আমাকে না করতে হয়।
পুত্র যখন তর্ক উঠাইল, তখন মাতাও আর ছাড়িতে চাহিলেন না। তিনি তাহার যুক্তি খাইবার জন্য কহিলেন, তাই বুঝি? তোকে না তিনি মাদ্রাসায় দিয়েছিলেন! তারপর তুই-ই তো নিজে ইচ্ছে করে মাদ্রাসা ছেড়ে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলি।
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা হয়েছিলাম বটে, কিন্তু তাতে কোনো দিনই আবার অমত ছিল না। তিনি বরাবর বলতেন, মাদ্রাসা পাস করে বেরুলে আমাকে ইংরেজি পড়তে দেবেন। ইংরেজি না পড়লে আজকাল–
মাতা বাধা দিয়া কহিলেন, তার ইচ্ছে ছিল, তুই মৌলবী হবি, তারপরে একটু ইংরেজি শিখবি; তা না, ফস্ করে মাদ্রাসা ছেড়ে ইংরেজি পড়া শুরু করে দিলি। এ-দিকও হল না, ও-দিকও হল না। আজ যদি তুই মৌলবী হতিস তবে আর ভাবনা ছিল কী! এখন কি আর মুরীদানরা তোকে মানবে?
আবদুল্লাহ্ অবজ্ঞাভরে কহিল, তা নাই-বা মানল; আমি তো আর তাদের দুয়ারে ভিখ মাগতে যাচ্ছি নে!
মাতা অনুযোগ করিয়া কহিলেন, ছি বাবা, অমন কথা বলতে নেই। মুরুব্বিরা সকলেই তো ঐ কাজ করে গেছেন। যারা অবুঝ, তাদের হেদায়েত করার মতো সওয়াবের কাজ কি আর আছে বাবা!
হ্যাঁ, হেদায়েত করা সওয়াবের কাজ বটে, কিন্তু তাতে পয়সা নেওয়াটা কোনোমতেই সওয়াব হতে পারে না। বরং তার উল্টো।
তারা খুশি হয়ে সালামী দেয়, ওতে দোষ নেই বাবা! সব দেশে, সকল জাতেই এ রকম দস্তুর আছে;–কেন, হিন্দুদের মধ্যে কি নেই!
তা থাকলই-বা; তাদের আছে বলেই যে আমাদের সেটা থাকতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই, আম্মা! আর এই পীর-মুরীদি ব্যবসায়টা হিন্দুদের পুরুতগিরির দেখাদেখিই শেখা, নইলে হযরত তো নিজেই মানা করে গেছেন, কেউ যেন ধর্ম সম্বন্ধে হেদায়েত করে পয়সা না নেয়।
আবদুল্লাহর এই বক্তৃতায় মাতা একটু অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়া কহিলেন, ওই তো ইংরেজি পড়ার দোষ, কেবল বাজে তর্ক করতে শেখে; শরীয়ত মানতে চায় না। তুই যে পীরগোষ্ঠীর নাম-কাম বজায় রাখতে পারবি নে, তা আমি সেই কালেই বুঝেছিলাম। সে যাকগে, যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন কী করবি, তাই ঠিক কর।
আবদুল্লাহ একটু চিন্তা করিয়া কহিল, পরীক্ষেটা যদি পাস করতে পারতাম, তবে একটা ভালো চাকরি জুটত। এখন চেষ্টা কল্লে বড়জোড় ত্রিশ কি চল্লিশ টাকা মাইনে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তার জন্যেও মুরুব্বি চাই যে, আম্মা! কাকে যে ধরব তাই ভাবছি।
যদিও ওলিউল্লাহ পুত্রকে প্রথমে মাদ্রাসায় দিয়াছিলেন, তথাপি তাহাকে ইংরেজি পড়াইবার ইচ্ছা তাহার খুবই ছিল। ইংরেজি না শিখিলে দুরবস্থা ঘুচিবে না, তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এদিকে ইংরেজি শিখিয়া লোকের আকিদা খারাপ হইয়া যাইতেছে, তাহাও তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন; কাজেই প্রথমে মাদ্রাসায় পড়াইয়া পুত্রের আকিদা পাকা করিয়া লইয়া তাহাকে ইংরেজি পড়িতে দিবেন মনে মনে তাহার এইরূপ সঙ্কল্প ছিল। কিন্তু জমাতে চাহরম পড়িয়াই যখন আবদুল্লাহ্ মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগে গিয়া ভর্তি হইল, তখন তিনি আর বাধা দেন নাই। তাহার পর ক্রমে এন্ট্রান্স ও এফ. এ. পাস করিয়া যখন সে বি. এ. পড়িতে লাগিল, তখন পুত্র হয় খুব দরের চাকরি পাইবে, না হয় উকিল হইয়া জেব ভরিয়া টাকা উপায় করিয়া আনিবে, এই আশা আবদুল্লাহর পিতামাতার অন্তরে জাগিয়া উঠিয়াছিল। তাহারা এই বলিয়া মনকে প্রবোধ দিলেন যে, ইংরেজি পড়িয়া সচরাচর ছেলেরা যেমন বিগড়াইয়া যায়, আবদুল্লাহ তেমন বিগড়ায় নাই। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রোজা রাখে; পাকা মুসল্লির মতো সকল বিষয়েই বেশ পরহেজ করিয়া চলে। এক্ষেত্রে ইংরেজি পড়িয়া পুত্র যদি বড়লোক হইতে পারে, তাহাতে বাধা দিবেন কেন? খোদা উহাকে যেদিকে চালাইয়াছেন, ভালোর জন্যেই চালাইয়াছেন।
এক্ষণে স্বামীর অকালমৃত্যুতে পুত্রের বি. এ. পাসের এবং বড়লোক হওয়ার আশা ভঙ্গ হইল; তাই আবদুল্লাহর জননীর মন বড়ই দমিয়া গিয়াছিল। যে হাকিম হইতে অথবা অন্তত জেলার একজন বড় উকিল হইতে পারিত, তাহার পক্ষে এখন সামান্য চাকরিও মিলা দুষ্কর হইয়া পড়িয়াছে, ইহাই মনে করিয়া তাহার অশ্রু ঝরিয়া পড়িল। অঞ্চলে চক্ষু মুছিতে মুছিতে তিনি কহিলেন, বাবা একটা কাজ কল্লে হয় না?