ক্রমে টাকা পয়সা সিকি দুআনিতে ভরিয়া রুমালখানি দারুণ ভারী হইয়া উঠিল। তখন সেখানি বেশ করিয়া বাধিয়া মেম্বারের পার্শ্বে রাখিয়া দিয়া আর একখানি রুমাল আনা হইল। এইরূপে তিন-চারিখানি রুমাল ভরিয়া ফেত্রা আদায় করা হইয়া গেলে মৌলবী সাহেব নামাযে খাড়া হইলেন। তখন ঈদগাহের পশ্চিম প্রান্ত রৌদ্রে ভরিয়া গেলেও মেন্বর প্রান্তস্থিত ভরা রুমালগুলি তাহাকে সূর্যতাপ অনুভব করিবার অবসর দিল না।
সকলে উঠিয়া কেবলামুখী হইয়া দাঁড়াইল। মৌলবী সাহেব চিৎকার করিয়া কহিলেন কাতার ঠিক করে দাঁড়াবেন, মিয়া সাহেবরা! পায়ের দিকে চেয়ে দেখবেন।
অমনি সকলে পার্শ্ববর্তীগণের পায়ের দিকে চাহিয়া দেখিয়া নড়িয়াচড়িয়া কাতার সোজা করিয়া লইল। নামায শুরু হইল।
নিয়ত করা হইয়া গেলে মৌলবী সাহেব সমুচ্চকণ্ঠে চারবার তীর উচ্চারণ করিলেন। অতঃপর সকলে তহরিমা বাধিয়া নতমস্তকে দাঁড়াইয়া ইমামের সুরা-পাঠ শ্রবণ করিতে লাগিল। ইমাম সাহেব বড়ই সুকণ্ঠ; প্রান্তর মুখরিত করিয়া তাহার মধুর কেরাত নামাযীগণের হৃদয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ক্রমে সুরা পাঠ শেষ হইলে আবার গম্ভীর রবে তীর উচ্চারিত হইল; অমনি সকলে যুগপৎ অর্ধঅবনমিত দেহে রুকু করিল–সুশিক্ষিত সেনাদল যেমন নায়কের ইঙ্গিতমাত্রে যন্ত্রচালিতের ন্যায় একযোগে আদেশ-পালনে তৎপর হয়, তেমনি তৎপরতার সহিত সকলে একযোগে রুকুতে অবনত হইল। আবার তীর উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তেমনই সকলে একযোগে দণ্ডায়মান হইল, এবং একযোগে ভূ-তলে জানু পাতিয়া ভূ-পৃষ্ঠ-মস্তকে সেজদা করিল। আল্লাহ্ যেমন এক তেমনি নামাযরত জনসংঘেরও যেন একই প্রাণ, একই দেহ!
দুই রাকাত নামায় দেখিতে দেখিতে শেষ হইয়া গেল; ইমামের সালাম পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সকলে দক্ষিণে ও বামে মস্তক হেলাইয়া সমগ্র মোসলেম-জগতের প্রতি মঙ্গল আশীর্বাদ বর্ষণ করিল।
তাহার পর ইমাম মোনাজাত করিলেন এবং সকলে দুই হাত তুলিয়া তাহার সহিত যোগদান করিল। মোনাজাত হইয়া গেলে তিনি দণ্ডায়মান হইয়া আরবি কেতাব হাতে লইয়া খোবা পড়িতে লাগিলেন। যদিও তাহার এক বর্ণও কাহারো বোধগম্য হইল না, তথাপি সকলে ধর্মবুদ্ধিপ্রণোদিত হইয়া গভীর মনোযোগের সহিত খোত্বা শ্রবণ করিতে লাগিল।
খোৎবার পর আবার মোনাজাত হইল। তাহার পর আলিঙ্গনের পালা। প্রত্যেকে একবার ইমামের সহিত এবং আর একবার পরস্পরের সহিত কোলাকুলি করিবার জন্য ব্যগ্রতা দেখাইতে লাগিল। যেন সকলেই ভাই ভাই, এক প্রাণ, এক আত্মা! একতার এমন নিদর্শন। শার কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না; কার্যক্ষেত্রে এমন নিদর্শনের এমন ব্যর্থতাও আর। সমাজে ঘটিয়াছে কি না সন্দেহ।
ঈদের নামায খতম হইল, যে যাহার ঘরে চলিল। মৌলবী সাহেবের রুমালে বাধা টাকা-পয়সার মোটগুলিও মোড়লের হাতে ঘরে চলিল! মৌলবী সাহেব তাহার ঘরে গিয়া সেখানে গনিয়া বাক্সবন্দি করিয়া আসিলেন, এবং আবদুল্লাহদের সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে চলিলেন।
বেলা প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় বাসায় পৌঁছিয়া যে-যাহার মুরব্বিগণের কদমবুসি করিল। মুরব্বিরাও সকলকে প্রাণ ভরিয়া দোয়া করিতে লাগিলেন।
তাহার পর আহারের পালা। ডাক্তারবাবুকে ডাকিয়া আনিবার জন্য সামুকে পাঠানো হইল। একটু পরেই ডাক্তারবাবু হসপিটাল অ্যাসিট্যান্ট বাবুকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিলেন। কহিলেন, এঁকে ধরে নিয়ে এলাম। একা একাই জাতটা খুইয়ে লেজকাটা শেয়াল হব? আরো যতগুলার পারি লেজ কেটে দি!
আবদুল্লাহ সবিনয়ে কহিল, বড়ই সুখের বিষয় যে আপনি এসেছেন। আপনার প্রেজুডিস নেই তা তো জানিনে, কাজেই বলতে সাহস করি নি।
ডাক্তারবাবু কহিলেন, আরে, এর আর বলাবলি কী? যারা মুরগি-মাটনের স্বাদ একবার পেয়েছে, তাদের আর বলতে-কইতে হয় না কিছু। কী বল, ভায়া? আর এ আমার নিজের বাড়ি–আমিই তো ওঁকে নিমন্ত্রণ করে এনেছি।
বৈঠকখানা-ঘরে দস্তরখান বিছানো হইল। অন্দর হইতে খাঞ্চা ভরিয়া খানা আসিতে লাগিল এবং আবদুল খালেকের চাকর সলিম রেকাবিগুলি যথাস্থানে সাজাইয়া দিল। চিলমচি, বদনা প্রভৃতি আসিল। আবদুল্লাহ্ প্রথমেই ডাক্তারবাবুয়ের হাত ধোয়াইয়া দিল। তৎপরে মৌলবী সাহেবকে হাত ধুইবার জন্য অনুরোধ করিলে তিনি কহিলেন যে, আর আর সকলের হাত ধোয়া হইয়া গেলে তিনি ধুইবেন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ ছাড়িল না, আপনি আগে ধোন। আপনারা আগে ধুয়ে নেন ইত্যাদি শিষ্টাচার কলহের পর মৌলবী সাহেবকেই হারিতে হইল–তিনিই সর্বাগ্রে হাত ধুইয়া লইলেন। এমনকি আবদুল্লাহ নিজেই তাহার হাতে জল ঢালিয়া দিল।
দস্তরখানে লোক বেশি নহে বলিয়া আর স্বতন্ত্র খাদেমের দরকার হইল না। আবদুল খালেক বসিয়া বসিয়াই সকলের রেকাবিতে তাম্বখশ করিয়া পোলাও পৌঁছাইয়া দিল এবং চামচে করিয়া কাবাব ও কোফতা বাটিতে লাগিল।
সুফী সাহেব আবদুল্লাহকে কহিলেন, উওহ্ নিমকদানঠো জারা বাঢ়া দিজিয়ে। আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি নিমকদান বাড়াইয়া দিল। তখন প্রত্যেকেই নিমক চাহিলেন, সুতরাং নিমকদানটা এবার সব হাত ঘুরিয়া আসিল।
সুফী সাহেব একবার সকলের মুখের দিকে চাহিতে চাহিতে জিজ্ঞাসুভাবে কহিলেন, বিসমিল্লাহ্? আবদুল্লাহ্ কহিল, জি হাঁ, বিসমিল্লাহ। খানা শুরু হইল।