আবদুল্লাহ্ কহিল, আপনার কাছে আরো একটা অনুরোধ আছে, মৌলবী সাহেব। নামায পড়াতে যাবার অনুরোধ তো রাখলেন না; তার বদলে আমরাই আসছি। কিন্তু এ অনুরোধটা রাখতেই হবে।
মৌলবী সাহেব কুণ্ঠিতভাবে কহিলেন, আমাকে এমন করে বলে কেন লজ্জা দিচ্ছেন আপনারা…
না, না, ওরকম কেন মনে কচ্ছেন আপনি! আমার অনুরোধ এই যে, কাল দুপুরবেলা আমাদের বাসায় আপনাকে দাওৎ কবুল কত্তে হবে।
মৌলবী সাহেব মোড়লের মুখের দিকে চাহিলেন। মোড়ল কহিল, তা ক্যামন করে হবে, মেয়া সাহেব, ঈদির দিন উনি আমাগোর বাড়ি না খালি হবে ক্যান্?
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা উনি রাত্রে এখানে খাবেনখন। উনি তো কেবল আপনাদেরই মৌলবী সাহেব নন, আমাদেরও মৌলবী সাহেব। আমরাও ওঁকে একবেলা খাওয়াব।
মোড়ল কহিল, না, ঈদের দিন ওনারে আমরা যাতি দি ক্যাম্নয়? আপনারা ওনারে পাছে খাওয়াবিন।
আমরা যে দুই-এক দিনের মধ্যে চলে যাচ্ছি মোড়লসাহেব। কাল ছাড়া আর আমাদের দিনই নেই।
কাজেই মোড়ল সাহেবকে হাল ছাড়িতে হইল। স্থির হইল যে, কাল নামায বাদ মৌলবী সাহেব ওখানে খাইতে যাইবেন, কিন্তু রাত্রে উহাদিগকে মোড়ল বাড়ির দাওয়াদ কবুল করিতে হইবে। অবশ্য কাল দ্বিপ্রহরে মোড়ল স্বয়ং গিয়া রীতিমতো দাওয়াদ করিয়া আসিবে। আবদুল্লাহ্ রাজি হইয়া গেল।
রাত্রে বাসায় ফিরিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিল, আবদুল খালেক আসিয়াছেন, তিনি কাজের ঝঞ্ঝাটে অনেক চেষ্টা করিয়াও এ কয়দিন আসিতে পারেন নাই বলিয়া কৈফিয়ত দিলেন। কিন্তু সে-সকল কৈফিয়তে কান দিবার মতো মনের স্থিরতা আবদুল্লাহর ছিল না। শ্বশুর কর্তৃক অপমানিত মৌলবীটিকে লইয়া কাল যে ব্যাপার ঘটাইতে হইবে, তাহারই ভাবনায় উন্মনা হইয়া ছিল। সে আবদুল খালেককে সকল কথা খুলিয়া বলিল। তিনিও অনুমোদন করিলেন দেখিয়া আবদুল্লাহ্ বড়ই খুশি হইয়া গেল।
পরদিন ভোরে উঠিয়াই আবদুল্লাহ্ আকবর আলী সাহেবের নিকটে উপস্থিত হইয়া ওপারে নামায পড়িতে যাইবার প্রস্তাব উত্থাপন করিল; কিন্তু আকবর আলী তাহাতে রাজি হইতে পারিলেন না। কহিলেন, যখন তাহারই চেষ্টায় ইহারা সকলে একটা জুমা-ঘর প্রস্তুত করিয়াছে, এবং কয় বৎসর ধরিয়া এখানে রীতিমতো নামায হইয়া আসিতেছে, তখন এ-স্থান ছাড়িয়া অন্যত্র নামায পড়িতে যাওয়া কর্তব্য হইবে না। বিশেষত একবার নামায বাদ পড়িলে ভবিষ্যতে ইহার স্থায়িত্ব সম্বন্ধে গোল ঘটিতে পারে।
অগত্যা আবদুল্লাহ্ স্থির করিল, কেবল তাহারাই কয়জন ওপারে যাইবে। আকবর আলী নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সে কহিল, যখন কথা দিয়া আসা হইয়াছে, তখন যাইতেই হইবে।
.
২৭.
বেলা দেড় প্রহর হইতে না হইতেই আবদুল্লাহরা নিকারিপাড়ার ঈদগাহে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন ঈদগাহ প্রায় ভরিয়া উঠিয়াছে। নিকটবর্তী বহু গ্রাম হইতে লোকে এইখানে ঈদ-বকরীদের নামায পড়িতে আসে, প্রায়-ছয় সাত শত লোকের জমাত হইয়া থাকে।
তাহারা আসিতেই সকলে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, এবং তাহাদের সালাম-সম্ভাষণের যুগপৎ প্রতি-সম্ভাষণে একটা সমুচ্চ গুঞ্জন উপস্থিত হইল। সকলেই বসিয়া ছিল–কেহ-বা মাদুর, কেহ-বা ছোট জায়নামাজ বা শতরঞ্জ পাতিয়া, কেহ-বা রঙিন রুমাল ঘাসের উপর বিছাইয়া স্থান করিয়া লইয়াছিল। মৌলবী সাহেব গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর লোকসহ। ভিড়ের মধ্যে নড়িয়াচড়িয়া, যে দুই-এক জন লোক তখনো আসিতেছিল, তাহাদিগকে বসাইবার বন্দোবস্ত করিতেছিলেন। তিনি একটু অগ্রসর হইয়া কহিলেন, তশরীফ লাইয়ে, হুজুর! আপনাদের দেরি দেখে ভাবছিলাম, বুঝি আর আসা হল না।
আবদুল্লাহ্ কহিল, না, না, মৌলবী সাহেব, না আসবার তো কোনো কারণই নেই। ওখান থেকে সবাইকে আনবার জন্যে চেষ্টা কচ্ছিলাম কিনা, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।
আর কেউ কি আসবেন?
না; তারা বলেন, এখানকার জুমা-ঘরে বরাবর নামায হয়ে আসছে, কাজেই সেটা বন্ধ করা ভালো দেখায় না।
মৌলবী সাহেব কহিলেন, তবে আর দেরি করে কাজ কী?
জমাতের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি বলিয়া উঠিল, নামায শুরু হয়ে যাক–রোদ তেতে উঠল!
আর এক ব্যক্তি দূর-প্রান্ত হইতে কহিল, এট্টু দেরেঙ্গ করেন আপনারা, ওই যে আরো কজন মুসল্লি আসতিছেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ঈদগাহটি এঁরা বেশ সুন্দর জায়গায় করেছেন কিন্তু! চারদিকে বড় বড় গাছ, সবটা জায়গা ছায়াতে ঢেকে পড়েছে। আরামে নামায পড়া যাবেখন।
মৌলবী সাহেব কহিলেন, কিন্তু দেরি হয়ে গেলে আর আরাম থাকবে না। ইমামের মাথার উপরেই রোদ লাগবে আগে!
আবদুল্লাহ এবার হাসিয়া কহিল, সেইজন্যেই বুঝি আপনি তাড়াতাড়ি কচ্ছেন?
মৌলবী সাহেব কহিলেন, তাও বটে, আর ঈদের নামাযে বেশি দেরি করা জায়েজ নয়, সেজন্যেও বটে।
এদিকে গ্রামের মোড়ল আর একজন মুসল্লি সঙ্গে লইয়া, দুই জনে একখানা বড় রুমালের দুই প্রান্ত ধরিয়া প্রত্যেকের নিকট হইতে ফেত্রার পয়সা আদায় করিতে আরম্ভ করিল। সেই মুসল্লিটি কহিতে লাগিল, ফেত্রার পয়সা দেন, মেয়া সাহেবরা! পোনে দু সের গমের দাম চোদ্দ পয়সা। ছোট বড়, কারো মাফ নেই। ছোট, বড় আওরত, মরদ। সলকার জন্যি ফেত্রা দেওয়া ওয়াজেব! হর হর বাড়ির মালিক জনে জনে হিসেব করে দেবেন! ফেত্রা না দিলি রোজার পুরা সওয়াব মেলে না!
রুমাল ঘুরিয়া চলিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন পয়সা পড়িতে লাগিল। কেহ কহিল, এই নেন আমার পাঁচ জোনের ফেতরা এক ট্যাহা ছয় পয়সা; কেহ আমি একলা মানুষ বলিয়া সাড়ে তিন আনা পয়সা ফেলিয়া দিল; কেহ-বা কহিল, আমি বড় গরিব, মেয়া সাহেব। খোদায় মাফ করবি!