সন্ধ্যার পরেই আকবর আলী সাহেব আসিয়া কহিলেন, সব্রেজিস্ট্রার সাহেব, কাল নামাযে ইমামতি করতে হবে আপনাকে।
আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, কেন, আপনাদের মৌলবী সাহেব কোথায় গেলেন!
আকবর আলী কহিলেন, তিনি তো সেদিনকার সেই গোলমালের পর থেকে আর এ-মুখো হন নি! সৈয়দ সাহেব সেদিন বেচারাকে সকলের সামনে যে অপমানটা করলেন, অমন কোনো ভদ্রলোক করে না। বেচারার মনে বড় চোট লেগেছে!
আবদুল্লাহ্ কহিল, আহা, তা লাগবারই কথা। আমার শ্বশুরের সেটা ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। তিনি মস্ত বড় শরীফ, এই অহঙ্কারেই তিনি একেবারে অন্ধ।
আকবর আলী কহিলেন, সে মৌলবী সাহেবকে তো আর পাওয়া যাবে না; এখন আপনাদের একজনকে ইমামতি কত্তে হচ্ছে। আপনার ওয়ালেদ সাহেবই যখন তাকে তাড়িয়েছেন, তখন আপনারই উচিত ক্ষতিপূরণ করা, সব্রেজিস্ট্রার সাহেব।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ক্ষতিপূরণ ও-ভাবে কলে তো হবে না–সেই মৌলবী সাহেবকে ডেকে যদি আমরা সকলে তার পিছনে নামায পড়ি, তবে কিছুটা হয় বটে।
আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, তিনি থাকেন কোথায়?
আকবর আলী কহিলেন, বেশি দূর নয়, ওপারে নিকারিপাড়ায়।
তবে তাকে খবর দিন না, কাল ঈদের নামাযে ইমামতি কত্তে।
আমি গত জুমায় তার কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম, তা তিনি আসলেন না।
আবদুল্লাহ কহিল, তবে এক কাজ করি না কেন? আমরা নিজেরা গিয়ে তাকে অনুরোধ করে আসি…
আবদুল কাদের কহিল, দোষ কী? কয়েকজন একসঙ্গে দু-তিনটে হেরিকেন নিয়ে যাবখন।
আকবর আলী কহিলেন, নিতান্তই যদি যেতে চান তবে আমি কয়েকজন লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু একথা সৈয়দ সাহেব জানতে পারলে আপনাদের আর আস্ত রাখবেন না…
আবদুল্লাহ্ বাধা দিয়া কহিল, ইঃ! কী করবেন আমাদের? ওঁর ও ফাঁকা আওয়াজের আমরা আর বড় তোয়াক্কা রাখি নে।
সেই রাত্রেই আবদুল্লাহ্ এবং আবদুল কাদের ওপারে নিকারিপাড়ায় গিয়া উপস্থিত হইল। মৌলবী সাহেব যে বাড়িতে ছিলেন, তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে বেশি বেগ পাইতে হইল না। তাহারা ঘরে উঠিয়া সালাম-সম্ভাষণ করিতেই মৌলবী সাহেব যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। বলিয়া উঠিলেন, এ কী আপনারা! এখানে!…
আবদুল্লাহ্ কহিলেন, জি হ্যাঁ, আমরাই, আপনারই কাছে এসেছি।
মৌলবী সাহেব কহিলেন, আপনাদের মতো লোকের আমার কাছে আসাটা একটু তাজ্জবের কথা বটে। কী মনে করে আপনাদের আসা হয়েছে?
কাল ঈদের নামায পড়াবার জন্যে আপনাকে বরিহাটী যেতে হবে।
মৌলবী সাহেব আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, আমাকে পড়াতে হবে? আবার?
সে কথা মনে করে আর কষ্ট করবেন না, মৌলবী সাহেব। যা হবার তা হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ–শরাফতের গুমোর ওঁদের হাড়ে-মাংসে জড়িয়ে আছে–ওঁর কথা ছেড়ে দিন। আমরা আছি–ওঁর মেজ ছেলে এই সব্রেজিস্ট্রার সাহেবও আছেন–আমরাই আপনাকে অনুরোধ কচ্ছি, মেহেরবানি করে এসে আমাদের ইমামতি করুন।
মৌলবী সাহেব চুপ করিয়া রহিলেন। আবদুল্লাহ্ আবার জিজ্ঞাসা করিল, কী বলেন, মৌলবী সাহেব?
মৌলবী সাহেব হাত দুটি জোড় করিয়া কহিলেন, আমাকে মাফ করুন। আমরা ছোটলোক হলেও একটা মান-অপমান জ্ঞান তো আছে! ধরুন, আপনাকেই যদি কেউ কোনোখানে অপমান করে, সেখানে কি আর আপনার যেতে ইচ্ছা করে? তার উপর এরা আবার আমাকে যত্ন করে রেখেছে–এদের ফেলে তো যাওয়া যেতেই পারে না।
এ কথার আর কি জওয়াব দেওয়া যায়? অথচ এ-বেচারার উপর যে অত্যাচারটা হইয়া গিয়াছে, তাহার একটা প্রতিকার করিবার জন্য আবদুল্লাহ্ উদ্বিগ্ন হইয়া রহিয়াছে। সে ভাবিতে লাগিল।
হঠাৎ আবদুল্লাহর মাথায় একটা খেয়াল আসিল। সে বলিয়া উঠিল, তবে আমরাও আসব আপনার সঙ্গে নামায পড়তে…
মৌলবী সাহেব যেন একটু সঙ্কোচের সহিত কহিলেন, আপনারা এতদূরে আসবেন কষ্ট করে…
কষ্ট আর কী, মৌলবী সাহেব, এই রাত্রে যখন আসতে পেরেছি, তখন দিনে এর চেয়েও সহজে আসতে পারব। কী বল, আবদুল কাদের?
আবদুল কাদের কহিল, তা তো বটেই! আমরা ঠিক আসব।
মৌলবী সাহেব একটু আমতা আমতা করিয়া তা–তবে– ইত্যাদি কী যেন বলিতে যাইতেছিলেন। আবদুল্লাহ বাধা দিয়া কহিল, আপনি মনে কিছু দ্বিধা করবেন না, মৌলবী সাহেব। আমাদের কোনো কু-মতলব নেই। সরলভাবেই বলছি, আপনি একজন আলেম লোক বলে আমরা আপনাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করি আপনার পিছনে নামায পড়া আমরা গৌরবের কথা বলেই মনে করব।
মৌলবী সাহেব যাহার বাড়িতে ছিলেন, সে লোকটা নিকারিদের মোড়ল। সেও সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বলিল, বেশ তো, আপনারা যেতি আমাগোর সাতে নোমায পড়তি আসেন, সে তো ভালো কতা!
আবদুল্লাহ্ কহিল, কেন আসব না? আমরা সব্বাই মুসলমান, ভাই ভাই। যত বেশি ভাই মিলে একসঙ্গে নামায পড়া যায়, ততই সওয়াব বেশি হয়। ঈদের নামায যেখানে বড় জমাত হয়, সেইখানেই গিয়ে পড়া উচিত–কী বলেন, মৌলবী সাহেব?
মৌলবী সাহেব কহিলেন, সে তো ঠিক কথা!
আবদুল্লাহ্ কহিল, ওপারে জমাত ছোট হয়। কজনই-বা লোক আছে বরিহাটীতে। আমি চেষ্টা করব, যাতে ওখানকার সকলেও এপারে এসে নামায পড়েন।
এ প্রস্তাবে সকলেই খুশি হইয়া উঠিল। মোড়ল কহিল, আমাগোর হ্যাঁপারে যে জোমাত হয়, মানুষির মাথা গুনে শ্যাষ করা যায় না। এই গেরদের বিশ তিরিশ হান্ গেরামের লোক আসে আমাগোর ঈদগায়ে নোমায পড়তি। মাঠহাও পেল্লায়–বহুত লোক বসতি পারে। এত বড় ঈদগা এ-গেরুদের মদ্দি নেই!