আবদুল্লাহ্ একটু দ্বিধার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, খেতে আপনার আপত্তি নেই?
কিছু না! আমার ওসব প্রেজুডিস নেই, বিশেষ করে আপনাদের ঘরের পোলাও কোরমা-কো–কাবাব–এইসবের কথা মনে উঠলে সব প্রেজুডিস পগার পার হয়ে যায়!
আবদুল্লাহ্ আহ্লাদিত হইয়া কহিল, তবে কাল দুপুরবেলা আমাদের এখানে চাট্টি নুন ভাত খাবেন…
ডাক্তারবাবু যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। নুন-ভাত? সে কী মশায়! আপনাদের বাড়িতে শেষটা নুন-ভাত খেয়েই জাতটা মারব?
আবদুল্লাহ্ হাসিয়া কহিল, তা মাল্লেনই যখন, তখন না হয় গরিবের বাড়ির নুন-ভাত খেয়েই এবার মারুন।
না, না, সেসব হবে না, মুরগি-মুসাল্লাম চাহিয়ে। একবার যা খেয়েছিলাম মশায়… বলিয়া ডাক্তারবাবু কবে কোন মুসলমান বাড়িতে কী কী খাইয়াছিলেন তাহার ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে রায় দিয়া ফেলিলেন, মাংসটা আপনাদের ঘরে খাসা রান্না হয়–অমন আমাদের ঘরে হয় না।
এমন সময় পাশের বাড়িতে একটা চিৎকার ছোটাছুটি গোলমাল শোনা গেল। ব্যাপার কী, জানিবার জন্য সকলে উৎকণ্ঠিত হইয়া বৈঠকখানা হইতে নামিয়া বাহিরে আসিলেন। ডাক্তারবাবুর বাসাটি হাসপাতালের হাতার এক প্রান্তে অবস্থিত। হাতার বাহিরে ছোট একটি বাগান, তাহার পর জনৈক উকিলের বাসাবাটী। সেইখানেই গোলমাল হইতেছিল। একজন চাকর হেই হেই দূর দূর রবে চিৎকার করিতে করিতে বাগানের দিকে ছুটিয়া আসিল; ইহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ একটা ঝি, এবং তাহারও পশ্চাতে ছোট ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে ঢিল হাতে দৌড়াইয়া আসিতেছিল। একটা মুরগি কটুকটুকটাআশ রবে ক্রন্দন করিতে করিতে তাহাদের সম্মুখে উড়িয়া হাসপাতালের হাতার মধ্যে আসিয়া পড়িল। বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হয়েছে রে রামা?
রামা নামক চাকরটি হাঁপাইতে হাঁপাইতে কহিল, হবে আর কী বাবু, মুরগি ঢুকেছে। বাড়িতে।
তারই জন্যে এত চেঁচামেচি? আমি বলি বুঝি-বা ডাকাত পড়েছে।
ঝি কহিল, বাঃ, রান্নাঘরের দোরে গে উঠল যে! ভাত-তরকারি সব গেল! বাবুর কাছারি যাবার সময় হল, কখন আবার ব্রাধবে? না খেয়েই বাবুকে কাছারি যেতে হবে। আর তাও বলি, আপনিই-বা কেমন ধারা মানুষ বাপু, বাড়িতে মুরগি পুষছে, তা কিছু বলচ না! আমাদের বাবু কত বকাবকি করে…
আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর গিয়া মামাটার ওপর তম্বি করিতে লাগিল! এত করে বলি, এ হিন্দুপাড়া, মুরগিগুলো বেঁধে রাখতে, তা কেউ সে কথা কানে করে না…
মামা কহিল, বাধাই তো ছিল ঠ্যাঙ্গে দড়ি দে। কম্নে যে খুলে পলায়ে গেছে তা ঠাওর কত্তি পারি নি।
তা নেও, এখন ওটাকে ধরে ভালো করে বেঁধে রাখ। আমাদের জন্যে ডাক্তারবাবুকে পর্যন্ত কথা শুনতে হচ্ছে। ভদ্দরলোক মনে করবে কী?
বাহিরে আসিয়া আবদুল্লাহ্ বলিল, ডাক্তারবাবু আপনাকে তো অনেক কষ্ট দিলামই, তার উপর আমাদের জন্যে আপনাকে অপদস্থ পর্যন্ত…
আরে রামঃ! এসব কথা কি গ্রাহ্য কত্তে আছে? আপনি বুঝি ভেবেছেন এ বাড়িতে মুরগির চাষ এই প্রথম? তা নয়; আমারই একপাল মুরগি ছিল। এদ্দিন ওরা কিছু বলতে সাহস করে নি–এখন আপনারা রয়েছেন কিনা, তাই একবার ঝালটা ঝেড়ে নিলে। আচ্ছা আমি এটা বুঝতে পারি নে, কাক ঢুকলে হাঁড়ি মারা যায় না, মুরগি ঢুকলে যায় কেমন করে? কাকে তো খায় না, এমন ময়লাই নেই!
আবদুল্লাহ্ কহিল, মুরগিটা যে আপনাদের সাংঘাতিক রকম অখাদ্য…
গোমাংসের চেয়েও?
তা না হতে পারে, কিন্তু অপবিত্র তো বটে।
আর কাকটা বুঝি ভারি পবিত্র হল? ওসব কোনো কথাই নয়। আমার মনে হয়, এর মূলে একটা বিদ্বেষ ভাব আছে। তা মরুক গে যাক–অপবিত্র হোক আর অখাদ্যই হোক, কাল কিন্তু ওটা চাই, নইলে সহজে জাত খোয়াচ্ছি নে…
এই বলিয়া ডাক্তারবাবু হাসিতে হাসিতে বিদায় লইলেন।
বৈকাল হইতেই রাবিয়ার পুত্র আবদুস সামাদ চাঁদ দেখিবার জন্য নদীর ধারে গিয়া দাঁড়াইল। কাছারির ফেরতা পিয়াদা-চাপরাসীরাও নদীর ধার দিয়া আকাশের দিকে চাহিতে চাহিতে চলিয়াছে। সন্ধ্যার একটু পূর্বেই ঈদের ক্ষীণ চন্দ্র-লেখা পশ্চিম আকাশের গায়ে ফুটিয়া উঠিল। দেখিতে পাইয়াই সামু আসিয়া চিৎকার করিয়া সকলকে ডাকিয়া কহিতে লাগিল, আম্মা, দাদু, চাঁদ উঠেছে, ওই দেখুন।
কই? কই? বলিতে বলিতে সকলে বাহিরে আসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া চাঁদ খুঁজিতে লাগিলেন! হালিমাও রাবিয়ার কাঁধে ভর করিয়া আস্তে আস্তে বাহিরে আসিয়া তাহাদের সঙ্গে যোগ দিল।
রাবিয়া প্রথমেই দেখিতে পাইল এবং ফুপু-আম্মাকে দেখাইবার জন্য বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল। চাঁদ এত ক্ষীণ যে কিছুতেই তাহার নজরে আসিল না। অবশেষে তিনি দুঃখিতচিত্তে কহিলেন, আর মা! সে চোখ কি আর আছে, যে দেখতে পাব? তোমরা দেখেছ, তাইতে আমার হয়েছে।
অতঃপর যে যাহার গুরুজনের কদমবুসি করিল। আবদুল্লাহ্ এবং আবদুল কাদেরও বাড়ির ভিতরে আসিয়া মুরব্বিগণের কদমবুসি করিয়া গেল। আবদুল্লাহর মাতা সকলকে দোয়া করিতে লাগিলেন, খোদা চিরদিন তোমাদের ঈদ মোবারক করুন!
হালিমা কদমবুসি করিতে আসিলে মাতা গদগদকণ্ঠে কহিলেন, থাক থাক, ব্যারাম নিয়ে আর সালাম করিস্ নে। এ ঈদে যে তুই আবার সালাম করবি, এ ভরসা ছিল না মা! শোকর তোর দরগায় খোদা! এই বলিয়া তিনি অঞ্চলে চক্ষু মুছিলেন।