কেবল সালেহাকে।
তাকে তুমি নিয়ে যেতে দেবে?
তা যাক না সে; সে তো কোনো কাজেই লাগছে না। আর ছোট তরফের ভাইজানকেও চিঠি লিখেছি; তিনিও হয়তো এসে পড়বেন–নেওয়াজ ভাইকেও বলে দেবখন তাকে শিগগির পাঠিয়ে দিতে। তোমার আর এখন বাসায় গিয়ে কাজ নেই–অনর্থক একটা বকাবকি মন-কষাকষি হবে। উনি যে যাচ্ছেন, এটা খোদার তরফ থেকেই হচ্ছে; থাকলে কেবল হাঙ্গামা কত্তেন বৈ তো নয়।
আবদুল্লাহর পরামর্শমতো আবদুল কাদের আবার আপিসে চলিয়া গেল। খোদা নেওয়াজ নৌকা ঠিক করিয়া আসিল। বৈকালেই সৈয়দ সাহেব সালেহাকে লইয়া রওয়ানা হইলেন। যাইবার সময় আবদুল্লাহর মাতা আপত্তি করিয়াছিলেন, কিন্তু আবদুল্লাহ্ তাঁহাকে বুঝাইয়া নিরস্ত করিয়াছিল। সুফী সাহেব রহিয়া গেলেন।
ঠিক সন্ধ্যার সময় আবদুল খালেক আসিয়া পৌঁছিলেন। সঙ্গে স্ত্রী রাবিয়া, পুত্র এবং মালেকা, একজন মামা এবং একজন চাকর।
২৬-৩০. হালিমার শুশ্রূষার ভার
রাবিয়া আসিয়া যখন হালিমার শুশ্রূষার ভার লইল, তখন সে বেচারির দুঃখ ঘুচিল। আবদুল্লাহর মাতাও রান্নাঘর হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন–রাবিয়ার মামা সেখানে তাহার স্থান। গ্রহণ করিল।
ডাক্তারবাবু এক্ষণে প্রত্যহ আসিয়া দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। রোগীর অবস্থা সম্বন্ধে এখনো নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না। ফুসফুঁসের অবস্থা আর বেশি খারাপ হয় নাই; খুব সম্ভব একুশ দিনে জ্বর ছাড়িতে পারে। কিন্তু সেই দিনটাই সঙ্কটের দিন। যদি ভালোয় ভালোয় কাটিয়া যায়, তবেই রক্ষা। ক্রমে কয়েক দিনের মধ্যে ডাক্তারবাবু আরো দুইবার ইনজেকশন দিলেন।
আবদুল খালেক দুই দিন পরেই চলিয়া গেলেন বাড়িতে কেহই নাই, একজন না। থাকিলে সেখানকার কাজকর্ম নষ্ট হইয়া যাইবে। যাইবার সময় বারবার করিয়া বলিয়া গেলেন যেন প্রত্যহ পত্র লেখা হয়, এবং সময় পাইলেই সত্বর অন্তত এক দিনের জন্যও একবার আসিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন।
আবদুল্লাহ্ বা আবদুল কাদের কাহাকেও আর এখন রোগিণীর শুশ্রূষা সম্বন্ধে কিছুই দেখিতে হয় না। তাহারা ঔষধাদি আনিয়া দিয়া এবং ডাক্তারবাবুর আদেশগুলি শুনাইয়া খালাস। রাবিয়া ও মালেকা পালা করিয়া রাত্রি জাগে। আবদুল্লাহ একবার রাত্রি জাগরণের। ভাগ লইতে চাহিয়াছিল; কিন্তু রাবিয়া তাহাকে আমল দেয় নাই। বলিয়াছিল, মেয়েমানুষের শুশ্রষা কি পুরুষমানুষ দিয়ে হয়?
একুশ দিনের দিন ডাক্তারবাবু বলিলেন, আজ বড় সাবধানে থাকতে হবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর দিবেন। রাত্রে আমার এইখানেই থাকা দরকার হতে পারে।
বৈকালের দিকে একটু একটু ঘাম দিয়া জ্বর কমিতে আরম্ভ করিল। সন্ধ্যার পর দেখা গেল, জ্বর ১০০ ডিগ্রির নিচে নামিয়াছে। ডাক্তারবাবুকে খবর দেওয়া হইল। তিনি তাড়াতাড়ি আহারাদি সারিয়া ব্যাগ হাতে করিয়া আসিলেন, এবং একবার হালিমার অবস্থা নিজে দেখিতে চাহিলেন। গিয়া দেখিলেন, হাত-পা বেশ একটু ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। জ্বর আরো কমিয়াছে এবং বেশ একটু ঘামও হইতেছে। কহিলেন, একটু পরেই জ্বর একেবারে ত্যাগ হইবে; কিন্তু যদি টেম্পারেচার বেশি নামে, তবেই বিপদ। দেখা যাক, কী হয়। যদি বেশি ঘাম হয়, তবে তৎক্ষণাৎ আমাকে ডাকবেন।
সে রাত্রে আর কাহারো ঘুম হইল না। দারুণ উৎকণ্ঠায় সকলে বসিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইতে লাগিলেন। রাত্রি প্রায় একটার সময় হালিমার অত্যন্ত ঘাম হইতে লাগিল এবং শরীর এলাইয়া পড়িল। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হইল। তিনি কহিলেন, যা ভেবেছিলাম কিন্তু ভয় নেই, ও ঠিক হয়ে যাবেখন। আর একটা ইনজেকশন দিতে হবে।
নূতন একটা ইনজেকশন দেওয়া হইল। কিছুক্ষণ পরে রোগীর অবস্থা একটু ফিরিল, শরীরে উত্তাপ বাড়িল, হাত-পা বেশ গরম হইয়া উঠিল, ঘাম বন্ধ হইল। সকলের মনে আশা হইল এ যাত্রা হালিমা বাঁচিয়া যাইবে।
কিন্তু শেষরাত্রের দিকে আবার ঘাম ছুটিল। ডাক্তারবাবু আবার ইনজেকশন দিলেন। ব্যাগ হইতে একটা তীব্র ঔষধ বাহির করিয়া একটু খাওয়াইয়াও দিলেন, এবং কহিলেন, ওঁকে এখন চুপ করে পড়ে থাকতে দিন, যদি একটু ঘুম হয়। আর ভয় নেই, হার্টের অবস্থা ভালো।
যাহা হউক, উদ্বেগে দুর্ভাবনায় রাত্রিটা একরকম কাটিয়া গেল। ভোরের দিকে হালিমার বেশ গাঢ় নিদ্রা হইল। ডাক্তারবাবু কহিলেন, আর কোনো ভয় নেই, এ যাত্রা উনি রক্ষা পেয়ে গেলেন। এখন ওঁর সেবা-শুশ্রূষার দিকেই একটু বেশি নজর রাখতে হবে।
পরদিন হইতে হালিমার অবস্থা ভালোই দেখা যাইতে লাগিল। কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে কথা কহিতে কষ্ট হয়। কাশিও একটু রহিয়া গেল। ডাক্তারবাবু বলকারক ঔষধের এবং দুবেলা মুরগির সুরুয়ার ব্যবস্থা করিলেন। রাবিয়া এবং মালেকার সযত্ন ও সস্নেহ শুশ্রূষায় হালিমা দেখিতে দেখিতে সুস্থ হইয়া উঠিল। আগের দিন ডাক্তারবাবু তাহাকে অন্ন-পথ্য করিবার অনুমতি দিলেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ডাক্তারবাবু, কাল আমাদের ঈদ, বড়ই আনন্দের দিন। তার উপর আমার বোনটি ঈশ্বরেচ্ছায় আর আপনার চিকিৎসার গুণে বেঁচে উঠেছে, কাজেই আমাদের পক্ষে ডবল আনন্দ। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে, তবে…
তবে কী?
আপনাকে নেমন্তন্ন কত্তে চাই?
ডাক্তারবাবু অতি আনন্দে বলিয়া উঠিলেন, বাঃ! হলে তো দেখছি তে-ডবল আনন্দ।