পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেব অগ্রসর হইয়া সৈয়দ সাহেবের পার্শ্ব দিয়া, সম্মুখস্থ পেশ নামাজের উপর গিয়া কালাল-জুমা পড়িতে লাগিলেন। আকবর আলী সঙ্গী কয়জনকে লইয়া সৈয়দ সাহেবের সহিত প্রথম কাতারে স্থান লইলেন। সৈয়দ সাহেব নামায শেষ করিয়া একমনে মাথা নিচু করিয়া বসিয়া নীরবে দোয়া-দরুদ পড়িয়া যাইতে লাগিলেন।
সানি আযান হইয়া গেল। এক্ষণে জুমার নামায শুরু হইবে। পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেব খোবা পাঠ করিবার জন্য কেতাব হাতে লইয়া, মুসল্লিগণের দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। সৈয়দ সাহেব তাহাকে এক নজর দেখিয়া লইবার জন্য মাথা উঁচু করিলেন।
সেই পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেবকে দেখিবামাত্র সৈয়দ সাহেবের চেহারা ভয়ঙ্কর রকম বদলাইয়া গেল! ঘৃণায় ও রাগে কাপিয়া কাপিয়া কেয়া হায়, এত্তা বাৎ! বলিতে বলিতে বৃদ্ধ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
না জানি কী ঘটিয়াছে মনে করিয়া অনেকেই সেইসঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল। আকবর আলী সাহেব ব্যস্ত সমস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী, কী সৈয়দ সাহেব, কী হয়েছে?
সৈয়দ সাহেব ক্রোধে উন্মত্তের ন্যায় হইয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, এত বড় আস্পর্ধা ওর! ব্যাটা জোলা, পাগড়ি বেঁধে এমামতি কত্তে এসেছে?
আকবর আলী দৃঢ়স্বরে কহিলেন, কেন, তাতে কী দোষ হয়েছে? উনি তো দস্তুরমতো পাস-করা মৌলবী, ওঁর মতো আলেম এদেশে কয়টা আছে, সৈয়দ সাহেব?
এঃ! আলেম হয়েছে! ব্যাটা জোলার ব্যাটা জোলা, আজ আলেম হয়েছে, ওর চৌদ্দ পুরুষ আমাদের জুতো বয়ে এসেছে, আর আজ কিনা ও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে এমামতি করবে, আর আমরা ওই ব্যাটার পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ব?
পাগড়িওয়ালা মৌলবী সাহেব ধীরভাবে কহিলেন, এটা আপনার বাড়ি নয়, সৈয়দ সাহেব, এটা মসজিদ, সে-কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন।
সৈয়দ সাহেব রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, চুপ রহ্, হারামজাদা! আভি তুঝকো জুতা মাকে নেকাল দেঙ্গে।
মুসল্লিগণের মধ্য হইতে এক ব্যক্তি বলিয়া উঠিলেন, উনি কোহাকার লাট সাহেব গো? আমাগোর মৌলবী সাহেবের গালমন্দ দিতি লাগলেন যে বড়! এ আমারগোর জুমা ঘর, দে তো দেহি কেমন করে ওনারে বার করে দিতি পারেন উনি!
আর একজন কহিল, ওনারেই দেও বার করে–ওসব সয়েদ ফয়েদের ধার আমরা ধারি নে–
আকবর আলী তাহাদিগকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন, সৈয়দ সাহেব, এটা আপনার অন্যায়। কেতাবমতো ধত্তে গেলে মুসলমানের সমাজেই উঁচু-নীচু বিচার নেই; তাতে আবার এটা খোদার ঘর–
সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া কহিলেন, তাই বলে জোলা তাঁতি নিকেরি যে-সে জাতের পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে হবে? ভালো চাও তো ওকে এক্ষুনি বের করে দাও, ওর পেছনে আমরা নামায পড়ব না।
সমবেত লোকের মধ্য হইতে একটা প্রতিবাদের কলরব উঠিল। একজন চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, উনি না পড়েন উনিই বেরিয়ে যান না কেন? আমরা মৌলবী সাহেবকে দিয়ে নামায পড়াবই।
চলে আইয়ে সুফী সাহেব। শালা জোহা-লোক জাহা মৌলভী বন্কে ইমাম হোতা হায়, ওহ ভালে আদ্মী কা রান্না দোরস্ত নেহী। এই বলিয়া সৈয়দ সাহেব সুফী সাহেবকে টানিয়া বাহিরে লইয়া আসিলেন। সুফী সাহেব বাহিরে আসিয়া একবার খাক–থু করিলেন এবং সৈয়দ সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া গেলেন। অতঃপর নির্বিবাদে জুমার নামায শুরু হইয়া গেল।
গরম মেজাজে বাসায় আসিয়া সৈয়দ সাহেব যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাহার মেজাজে একেবারে আগুন লাগিয়া গেল। তিনিও ঘরে ঢুকিতেছেন, ডাক্তারবাবুও স্টেথসকোপ গুটাইয়া পকেটে ভরিতে ভরিতে বাহির হইতেছেন। পশ্চাতে আবদুল্লাহ্ এবং বারান্দায় খোদা নেওয়াজ।
সৈয়দ সাহেব থমকিয়া দাঁড়াইয়া চক্ষু লাল করিয়া একবার প্রত্যেকের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। ডাক্তারবাবু বরাবর বাহির হইয়া চলিয়া গেলেন।
তোমাদের নিতান্তই কপাল পুড়েছে, আমি দেখছি। যা খুশি তাই কর তোমরা কিন্তু আমি এখানে আর এক দণ্ডও নয়। খোদা নেওয়াজ, যাও, নৌকা ঠিক কর গিয়ে। সওয়ারী যাবার নৌকা চাই।
খোদা নেওয়াজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, সওয়ারী কেন, হুজুর?
সৈয়দ সাহেব চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, যা বলি তাই কর, কৈফিয়ত তলব কোরো না।
খোদা নেওয়াজ চলিয়া গেল। সৈয়দ সাহেব গুম হইয়া বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, এদের সকলকে কি নিয়ে যাবেন?
সৈয়দ সাহেব কহিলেন, না। কেবল সালেহাকে নিয়ে যাব। তোমাদের এসব বে-পরদা কারবারের মধ্যে ওকে আমি রাখতে চাই নে। বউমাকে নিয়ে তোমরা যা খুশি তাই কর। ছেলেই যখন অধঃপাতে গেছে তখন বউ নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাব?
আবদুল্লাহ্ বলিতে যাইতেছিল যে তাহার স্ত্রীকে সে যাইতে দিবে না। কিন্তু আবার ভাবিল, তাহাকে রাখিয়াও যে বড় কাজের সুবিধা হইবে, এমন নয়; বরং তাহাকে ধরিয়া রাখিতে গেলেই শ্বশুরের সঙ্গে একটা মনোবিবাদের সৃষ্টি হইয়া যাইবে, এবং স্ত্রীরও মনে কষ্ট দেওয়া হইবে। সুতরাং সে স্থির করিল, বাধা দিয়া কাজ নাই।
এক্ষণে আবদুল কাদেরকে সংবাদ দেওয়া উচিত বিবেচনা করিয়া আবদুল্লাহ্ তাড়াতাড়ি আপিসের দিকে চলিল। পথেই আবদুল কাদেরের সহিত তাহার দেখা হইল। খোদা নেওয়াজ তাহাকে আগে খবর দিয়া পরে নৌকা ঠিক করিতে গিয়াছিল।
আবদুল কাদের ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আব্বা নাকি সকলকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন?