ওলিউল্লাহ্ পীরগঞ্জের পীর-বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। পূর্বে পরিগঞ্জের চতুষ্পার্শ্বে বহু গ্রামে ইহাদের মুরীদান ছিল বলিয়া পূর্বপুরুষগণ নবাবি হালে জীবন কাটাইয়া গিয়াছেন। কিন্তু কালক্রমে মুরীদানের সংখ্যা কমিয়া কমিয়া এক্ষণে সামান্য কয়েক ঘর মাত্র অবশিষ্ট থাকায় ইহাদের নিদারুণ অবস্থা বিপর্যয় ঘটিয়াছে। সে প্রতিপত্তিও আর নাই, বার্ষিক সালামীরও সে প্রতুলতা নাই; কাজেই ওলিউল্লাহকে নিতান্ত দৈন্যদশায় দিন কাটাইতে হইয়াছে। তথাপি যে দুই-চারি ঘর মুরীদান তিনি পাইয়াছিলেন, তাহাদের নিকট প্রাপ্য বার্ষিক সালামীর উপর নির্ভর করিয়াই তিনি একমাত্র পুত্রকে কলিকাতায় রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইতেছিলেন। সুতরাং তাহার অকালমৃত্যুতে আবদুল্লাহর আর খরচ চালাইবার কোনো উপায়ই রহিল না; বরং এক্ষণে কী উপায়ে সংসার চালাইবে, সেই ভাবনায় সে আকুল হইয়া উঠিল।
আবদুল্লাহর বিবাহ অনেক দিন পূর্বে হইয়া গিয়াছিল। তাহার শ্বশুরালয় একবালপুরে; শ্বশুর সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস তাহার পিতার আপন খালাতো এবং মাতার আপন ফুফাতো ভাই ছিলেন। আবার সেই ঘরেই তাহার এক শ্যালক আবদুল কাদেরের সহিত, আবদুল্লাহর একমাত্র ভগ্নী হালিমারও বিবাহ হইয়াছিল। এই বদল-বিবাহ আবদুল্লাহর পিতামহীর জীবদ্দশায় তাঁহারই আগ্রহে সম্পন্ন হয়।
সৈয়দ আবদুল কুদ্সের মাতা আবদুল্লাহ্ পিতামহীর সহোদরা ছিলেন। এই দুই ভগ্নীর মধ্যে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল; এবং তাহারা পরস্পরের নাতি-নাতিনীর বিবাহ দিবার জন্য বড়ই আগ্রহান্বিত ছিলেন। কিন্তু তাহাদের এ সম্প্রীতি সন্তানদিগের মধ্যে প্রসারিত হয় নাই; কেননা সৈয়দরা সম্পন্ন গৃহস্থ, এবং খোন্দকারেরা এক সময়ে যথেষ্ট ঐশ্বর্য ও সম্ভ্রমের অধিকারী থাকিলেও, আজ নিতান্ত দরিদ্র, ধরিতে গেলে একরূপ ভিক্ষোপজীবী। তাই আবদুল কুদ্দুস প্রথমে ওলিউল্লাহর সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে নারাজ ছিলেন; কিন্তু অবশেষে মাতার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তাহাকে এই বদল-বিবাহে সম্মত হইতে হইয়াছিল।
বিবাহের পর হইতে হালিমা বৎসরের অধিকাংশ কালই শ্বশুরালয়ে থাকিত; কিন্তু আবদুল্লাহর শ্বশুর কন্যাকে অধিক দিন পীরগঞ্জে রাখিতেন না। তাই বলিয়া আবদুল্লাহর পিতামাতার মনে যে বিশেষ ক্ষোভ ছিল, এমত নহে। তাহারা বড় ঘরে একমাত্র পুত্রের বিবাহ দিয়া এবং না-খাইয়া না-পরিয়া তাহাকে লেখাপড়া শিখিতে দিয়া, এই ভরসায় মনে মনে সুখী হইতেন যে, খোদা যদি দিন দেন, তবে পুত্র কৃতবিদ্য হইয়া যখন প্রচুর অর্থ উপার্জন করিবে, তখন বউ আনিয়া সাধ-আহ্লাদে মনের বাসনা পূর্ণ করিবেন। এখন সে। বড়লোকের মেয়েকে আনিয়া কেবল খাওয়া-পরার কষ্ট দেওয়া বৈ তো নয়!
কিন্তু আবদুল্লাহর পিতার সে সাধ আর পূর্ণ হইল না; এমনকি মৃত্যুকালেও তিনি পুত্রবধূর মুখ দেখিতে পাইলেন না। আবদুল্লাহ্ বাটী আসিয়াই পিতার কঠিন রোগের সংবাদ শ্বশুরালয়ে পাঠাইয়াছিল এবং হালিমাকে ও তাহার স্ত্রীকে সত্বর পাঠাইয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা সে অনুরোধ রক্ষা করেন নাই।
আবদুল্লাহর সংসারে এখন এক মাতা এবং তাহার পিতামহের বাঁদী-পুত্রের বিধবা স্ত্রী করিমন ভিন্ন অন্য কোনো পরিজন নাই। করিমন বাঁদী হইলেও আপনার জনের মতোই এই সংসারে জীবন কাটাইয়া বুড়া হইয়াছে। সে গৃহকর্মে আবদুল্লাহর মাতার সাহায্য করে, এবং আবশ্যকমতো বাজারবেসাতিও করিয়া আনে।
এই ক্ষুদ্র সংসারটির খরচপত্র ওলিউল্লাহ্ যে ব্যবসায়ের আয় হইতে কষ্টেসৃষ্টে নির্বাহ করিতেন, আবদুল্লাহর সে ব্যবসায় অবলম্বনে একেবারেই প্রবৃত্তি ছিল না। সে ভাবিতেছিল, চাকরি করিতে হইবে। যদিও সে বি. এ.-টা পাস করিতে পারিল না, তথাপি উপস্থিত ক্ষেত্রে সামান্য যে কোনো চাকরি তাহার পক্ষে প্রাপ্য হইতে পারে, তাহারই দ্বারা সে সংসারের অসচ্ছলতা দূর করিতে সমর্থ হইবে।
এইরূপ স্থির করিয়া আবদুল্লাহ তাহার মাতাকে গিয়া কহিল যে, সে আর পড়াশুনা করিবে না, কলিকাতায় গিয়া যাহা হোক একটা চাকরির চেষ্টা করিবে।
হঠাৎ পুত্রের এইরূপ সঙ্কল্পের কথা শুনিয়া মাতার মন বড়ই দমিয়া গেল। বি. এ. পাস করিয়া বড় চাকরি করিবে কিংবা জজের উকিল হইবে–ইহাই আবদুল্লাহ্ চিরদিনের আশা; কী গভীর দুঃখে যে সে আজ সেই চিরদিনের আশা ত্যাগ করিয়া চাকরির সন্ধানে বাহির হইবার প্রস্তাব করিতেছে, মাতা তাহা বুঝিতে পারিলেন। তাই নিতান্ত ব্যাকুল-কাতর দৃষ্টিতে পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কোনো কথা কহিতে পারিলেন না।
আবদুল্লাহ্ তাহার মাতার কাতর দৃষ্টি সহিতে পারিত না। এক্ষণে কী বলিয়া তাহাকে সান্ত্বনা দিবে ঠিক করিতে না পারিয়া কহিতে লাগিল, তা আর কী করব আম্মা, এখন সংসার-খরচই চলবে কেমন করে তাই ভেবে দিশে পাচ্ছি নে। যদি সুবিধেমতো একটা চাকরি পাই, তা হলে সংসারটাও চলে যাবে, ঘরে বসে পড়ে পাস করাও যাবে…
মাতার বুক ফাটিয়া একটা গভীর নিশ্বাস পড়িল। তিনি ধীরে ধীরে কহিলেন, যা ভালো বোঝ, কর বাবা। সবই খোদার মরজি।
এই বলিয়া তিনি চুপ করিলেন। আবদুল্লাহ মনে মনে কলিকাতায় যাইবার দিন স্থির করিয়া কথা কী করিয়া পড়িবে, তাহাই ভাবিতেছে, এমন সময় মাতা আবার কথা কহিলেন,