ইমদাদুল হকের ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য কৌতুকময়তা এবং তাঁর কৌতুকে আছে মননশীলতা ও মার্জিত রুচির স্বাক্ষর। যেমন–
ক. বৈঠকখানার এক প্রান্তে তখন এ বাটীর পারিবারিক মক্তব বসিয়া গিয়াছে। একখানি বড় অনতিউচ্চ চৌকির উপর ফর্শ পাতা; তাহারই উপর বসিয়া পূর্বাঞ্চল-নিবাসী বৃদ্ধ মৌলবী সাহেব আরবী, ফারসী এবং উর্দু সবকের রাশিতে ছোট ছোট ছেলেদের মাথা ভরাট করিয়া দিতেছে।১৭।
খ. এইরূপ বহু অলৌকিক ঘটনার বর্ণনার পর মৌলুদ-খান সাহেব এক দীর্ঘ মোনাজাত (প্রার্থনা) করিয়া মৌলুদ শরীফ সাঙ্গ করিলেন। সমস্তই উর্দু ভাষাতে কথিত ও গীত হইল; অধিকাংশ লোকই তাহার এক বর্ণও বুঝিল না; কিন্তু তাহাতে পুণ্যসঞ্চয়ের কোন বাধা হইল না।১৮
প্রায় সকল লেখকের মতো, ইমদাদুল হকেরও যাত্রা শুরু কবিতার স্নিগ্ধতা নিয়ে। তবে। এ-উপন্যাসে তার সেই কবিসত্তা সুপ্তই থেকেছে, মাঝে একবার মাত্র প্রকৃতি-বর্ণনায় আঁখি জল (১৯০০) আর লতিকা-র ইমদাদুল হক উঁকি দিয়েছেন এখানে–
তখন শরৎকাল প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। মাঠগুলি পরিপূর্ণ; মৃদুমন্দ বায়ু হিল্লোলে তাহাদের শ্যামল হাস্য ক্ষণে ক্ষণে তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিতেছে। এই অপূর্ব নয়ন-তৃপ্তিকর দৃশ্য দেখিতে এবং শারদীয় প্রভাতের সুখ-শীতল সমীরণের মধুর স্পর্শ অনুভব করিতে করিতে আবদুল্লাহ্ মাঠের পর মাঠ এবং গ্রামের পর গ্রাম পার হইয়া চলিতে লাগিল।১৯
ইমদাদুল হক প্রায়শই প্রবাদ-প্রবচনের অব্যর্থ ভাষ্যে তুলে ধরেন আপন বক্তব্য, যা আবদুল্লাহ উপন্যাসের ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উপমা-উৎপ্রেক্ষা তার শিল্পচেতনার প্রাতিস্বিকতাকেই প্রমাণিত করে। তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি চরিত্রের ভাবনাপুঞ্জের অনুগামী করে নির্মাণ করেন উপমা-উৎপ্রেক্ষা। যেমন–
ক. পথে হঠাৎ সাপ দেখিলে মানুষ যেমন এক লক্ষে হটিয়া দাঁড়ায়, সেও তেমনি হটিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, আহা, করেন কি, করেন কি, গোলদার সাহেব!২০
খ. দমাদম্ ঢোলে ঘা পড়িতে লাগিল। মদনের মনে হইল, যেন সে ঘা তাহার বুকের ভিতরই পড়িতেছে। ২১
গ. হালিমাকে সঙ্গে লইয়া আবদুল্লাহ্ যখন গৃহে ফিরিল, তখন মাতা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন।২২
০৪.
আবদুল্লাহ উপন্যাস মোট ৪১ পরিচ্ছেদের সমষ্টি হলেও, কাজী ইমদাদুল হক লিখেছেন এর প্রথম ৩০ পরিচ্ছেদ মাত্র; বাকি ১১টি পরিচ্ছেদ লিখে উপন্যাসটির একটা সন্তোষজনক সমাপ্তি টেনেছেন কাজী আনোয়ারুল কাদীর। মোসলেম ভারত (১৯২০) পত্রিকা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ইমদাদুল হকের অসুস্থতাজনিত কারণে আবদুল্লাহ শুধুই ইমদাদুল হকের রচনা থাকেনি–তবে এই অর্থেই এটি ইমদাদুল হকের রচনা যে কাজী আনোয়ারুল কাদীর মূলত ইমদাদুল হকের খসড়া অবলম্বন করেই উপন্যাসটি সমাপ্ত করেছেন। যে ১১টি পরিচ্ছেদ আনোয়ারুল কাদীর লিখেছেন, তাতে তাঁকে ইমদাদুল হকের মতো সমাজের চিত্রকর ততটা মনে হয়নি, যতটা মনে হয়েছে চরিত্রের মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষক। আনোয়ারুল কাদীর অতি সংক্ষেপে পরিচ্ছেদগুলো শেষ করেছেন, ফলে তার স্বাতন্ত্র তেমন প্রকাশিত হতে পারেনি। তবু দু-একটি পরিচ্ছেদে তার শিল্পপ্রতিভার স্পর্শ লেখেছে। সালেহার মৃত্যু দৃশ্য কিংবা সৈয়দ সাহেবের অন্তিমযাত্রা বর্ণনায় তিনি অনেক সংযতবাক এবং নিরাসক্ত। বোধ করি, আনোয়ারুল কাদীরের শিল্পপ্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য পরিমিতিবোধ; বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যু-বর্ণনায় তার এই বৈশিষ্ট্য চমৎকার প্রকাশিত হয়েছে।
০৫.
সমাজবীক্ষণ যদি আধুনিক ঔপন্যাসিকের অন্যতম লক্ষণ হয়, তবে আবদুল্লাহ্-র স্রষ্টা ইমদাদুল হক আধুনিক ঔপন্যাসিকদের সগোত্র; কিন্তু তবু তিনি সফল ঔপন্যাসিক নন। তিনি সমাজ-প্রাঙ্গণ থেকে অনেক উপাদান সংগ্রহ করেছেন; কিন্তু কতটুকু রাখবেন আর কতটুকু বাদ দিবেন– তা তিনি বুঝতে চাননি কিংবা জানতেন না। তাই প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে; শিল্পী ইমদাদুল হকের পরাভব ঘটেছে শিক্ষাব্রতী সমাজ-সংস্কারক খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হকের হাতে। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আবদুল্লাহ মহৎ উপন্যাস। হতে পারেনি। তবু একটি বিশেষ সময়ের মুসলিম-জীবনবিশ্বাস ও জীবনযন্ত্রণার শিল্পরূপ হিসেবে আবদুল্লাহ-র মূল্য অনস্বীকার্য এবং পুনরায় বলছি–একগুচ্ছ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, আবদুল্লাহ্-ই নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের প্রথম শিল্পসন্তান। শিল্পসিদ্ধিতে কালজয়ী মহিমা দাবি না করলেও, সমাজবিকাশের ইতিহাস হিসেবে আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের মূল্য কোন সূত্রেই অকিঞ্চিৎকর নয়।
ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
০১-০৫. বি. এ. পরীক্ষা
আবদুল্লাহ – উপন্যাস – কাজী ইমদাদুল হক
বি. এ. পরীক্ষার আর কয়েক মাস মাত্র বাকি আছে, এমন সময় হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় আবদুল্লাহর পড়াশুনা বন্ধ হইয়া গেল।
পিতা ওলিউল্লাহর সাংসারিক অবস্থা সচ্ছল ছিল না। পৈতৃক সম্পত্তি যাহা ছিল, তাহা অতি সামান্য; শুধু তাহার উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হইলে সংসার চলিত না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি পৈতৃক খোন্দকারী ব্যবসায়েরও উত্তরাধিকার পাইয়াছিলেন বলিয়া নিতান্ত অন্ন-বস্ত্রের জন্য তাহাকে বড় একটা ভাবিতে হয় নাই।