ওঃ, ভারি ত লবাব দেখি! কে হে তুমি, বাড়ি বয়ে এসে লম্বা লম্বা কথা কইতে লেগেছো?
লোকটা গজর গজর করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ্ ফিরিয়া চলিল। তাহাকে বিষণ্ণ মুখে ফিরিতে দেখিয়া গাড়োয়ান কহিল, দেলে না বুঝি? আমি জানি ও ঠাহুর ভারি ত্যান্দোড়। তবু আপনেরে একবার যাতি কলাম, ভদ্দর লোক দেখলি যদি যাতি দেয়।
গাড়োয়ানের সঙ্গে নিজে কাদায় নেমে গাড়ি চালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আবদুল্লাহ্। অবশেষে গ্রামের লোকদের সাহায্যে তারা গাড়ি খাদ থেকে তুলে নিতে সক্ষম হয়। তখন ব্রাহ্মণ ব্যক্তির অভিব্যক্তি–
ব্রাহ্মণটি উঠিয়া গিয়াছিলেন; কিছুক্ষণ পরে পান চিবাইতে চিবাইতে ডাবা হাতে আবার বাহিরে আসিয়া বসিলেন।…
যাইবার পূর্বে আবদুল্লাহ সেই ডাবা-প্রেমিকটির দিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল ঠাকুরমশায় তাহাদের দিকে তাকাইয়া আছেন এবং সুস্থচিত্তে ধূমপান করিতেছেন।১৩
অপ্রধান চরিত্রসমূহের ক্ষেত্রেও ইমদাদুল হকের এমন শৈল্পিক-সিদ্ধি লক্ষণীয়। বরিহাটী গভর্নমেন্ট স্কুলের হেডমাস্টার, পূর্বাঞ্চল-নিবাসী মৌলবী সাহেব, কলকাতার পীর সাহেব কিংবা রেলস্টেশনের হোটেলওয়ালার চরিত্র নির্মাণে ইমদাদুল হক রেখেছেন অসামান্য সাফল্যের স্বাক্ষর। পূর্বাঞ্চল-নিবাসী মৌলবী সাহেব এক বিস্ময়কর চরিত্র। এ-চরিত্রসূত্রে ইমদাদুল হক একদিকে যেমন তুলে ধরেছেন সমাজের শ্রেণী-বৈষম্যের উৎকট চেহারা; তেমনি তার আপন অস্তিত্বের অভিলাষ। সৈয়দ সাহেবের পারিবারিক মক্তবে প্রভু-পুত্র বাঁদী-পুত্রদের পাঠ-প্রদানে বৈষম্যের কারণ জিজ্ঞাসায় মৌলবী সাহেবের অকপট উচ্চারণ–
মৌলবী সাহেব আবদুল্লাহর আরো কাছে ঘেঁষিয়া আসিয়া ফিসফিস করিয়া কহিতে লাগিল, খতাড়া খি, বোলেননি, দুলহা মিঞা? অরা অইলো গিয়া আত্রাফগোর ফোলাফান, অরা এইসব মিয়াগোরের হমান চলতাম্ ফারে? অবৃগো জিয়াদা সবক দেওয়া মানা আছে, বোজুলেননি?
এতক্ষণে আবদুল্লাহ্ এই পাঠদান-কৃপণতার মর্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইল। পাছে প্রতিবেশী সাধারণ লোকের ছেলেরা নিজেদের ছেলেদের অপেক্ষা বেশী বিদ্যা উপার্জন করিয়া বসে, সেই ভয়ে তাহার শ্বশুর এইরূপ বিধান করিয়াছেন। সে আবার জিজ্ঞাসা করিল, তা ওদের পড়তে আসতে দেন কেন? একেবারেই যদি ওদের না পড়ান হয়, সেই ভাল নয় কি?
এই কথায় মৌলবী সাহেবের হৃদয়ে করুণা উথলিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, অহহঃ, হেডা কাম বালা অয় না, দুহা মিঞা! গরীব তাবেলম হিব্বার চায়, এক্কেবারে নৈরাশ করলে খোদার কাছে কি জবাব দিমু? গোমরারে এলেম দেওনে বহুত সওয়াব আছে কেতাবে ল্যাহে।১৪
আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে ইমদাদুল হক মূলত এঁকেছেন সমাজচিত্র, তাই কোন চরিত্রেরই ব্যক্তিক মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণে তিনি উৎসাহী নন। নজিবর রহমানের আনোয়ারা-র মতোই আবদুল্লাহ্ সমকালীন মুসলিম-জীবনবিশ্বাসের শিল্প-প্রতিমা। তবে আনোয়ারার ঘটনাসংস্থান কিংবা চরিত্রচিত্রণ-প্রক্রিয়া যেখানে সষ্টার সামন্ত-মূল্যচেতনা ও নীতিবোধ নিয়ন্ত্রিত, সেখানে আবদুল্লাহ্-র ঘটনাংশ, চরিত্রসৃজন-কৌশল কিংবা পরিপ্রেক্ষিত-উন্মোচন একান্তই বিকাশোন্মুখ বুর্জোয়া মানবতা-শাসিত। ইমদাদুল হক সম্পূর্ণ স্বাধীন-চিত্তের ও মৌলিক পর্যবেক্ষণ-শক্তির পরিচয় দিয়েছেন আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে। এ-বইটি বাঙালি মুসলমান সমাজের ক্ষয়িষ্ণু আদর্শ ও পরিহার্য রীতিনীতি-সমালোচনার এক স্মরণীয় প্রচেষ্টা।১৫
০৩.
লেখকের ব্যক্তি-সংবেদনা এবং সমাজচৈতন্যের চিত্র ও চিত্রকল্পময় বর্ণনাত্মক নির্মিতির নাম যদি হয় উপন্যাস, তবে ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ্-কে আমরা দিতে পারি না একটা সফল উপন্যাসের অভিধা। উপন্যাসের গঠনশৈলী এবং প্রকরণ–পরিচর্যার দিকে ইমদাদুল হক তেমন মনোযোগী ছিলেন না; পূর্বেই বলেছি, তার কেন্দ্রীয় দৃষ্টি মূলত বহির্বাস্তব বৃহত্তর সমাজ-অঙ্গনেই ছিল বিচরণশীল। উপন্যাসের যে-কেন্দ্রানুগশক্তি সকল খণ্ডচিত্রকে একটি অখণ্ড মালায় গ্রথিত করে, তা এখানে নেই। কাহিনীর কেন্দ্রে থেকেও আবদুল্লাহ্ পালন করতে পারেনি সেই কেন্দ্রানুগ শক্তির ভূমিকা। ফলে উপন্যাস-অবয়ব ধারণ করেও আবদুল্লাহ অন্তিম বিচারে থেকে যায় প্যারীচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-৮৩) আলালের ঘরের দুলাল-এর (১৮৫৮) মতোই সমাজের চিত্রমালা হিসেবে।
উপন্যাসের বর্ণনাংশে এবং সংলাপের ভাষা-ব্যবহারে ইমদাদুল হক সচেতন প্রযত্নের স্বাক্ষর রেখেছেন। উপন্যাসের যে-অংশ লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের আলোয় রচিত হয়েছে, সেখানকার ভাষা সাধুরীতির; আর চরিত্রসমূহের সংলাপে আছে চলিতরীতি। পূর্বাঞ্চলীয় মৌলবী সাহেব কিংবা কলকাতার পীর সাহেবের মুখে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে ইমদাদুল হক বিস্ময়কর সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষা-ব্যবহারের সম্ভাবনার সীমা মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে ইমদাদুল হকের হাতেই প্রথম প্রসারিত হয়েছে। প্রকরণ–পরিচর্যায় ইমদাদুল হক সচেতন ছিলেন না–পূর্বেই বলেছি। তবু কখনো কখনো কিছু বর্ণনাত্মক পরিচর্যা পাঠকের সংবেদনাকে আকর্ষণ করে। এমন একটি দীপ্র এলাকা–
বৈঠকখানা ঘরটি নিরতিশয় জীর্ণ এবং আসবাবপত্রও তাহার অনুরূপ। বসিবার জন্য একখানি ভগ্নপ্রায় চৌকি–সে এত পুরাতন যে, ধুলা-বালি জমিয়া জমিয়া তাহার রং একেবারে কালো হইয়া গিয়াছে। চৌকির উপর একটি শতছিদ্র ময়লা শতরঞ্জি পাতা, তাহার উপর ততোধিক ময়লা দুই-একটা তাকিয়া, উহার এক পার্শ্বে সদ্যব্যবহৃত ক্ষুদ্র জায়নামাজটি কোণ উল্টাইয়া পড়িয়া আছে। মেঝের উপর একটা গুড়গুড়ি, নয়চাটীতে এক ন্যাকড়া জড়ান হইয়াছে যে, তাহার আদিম আবরণের চিহ্নমাত্রও আর দৃষ্টিগোচর হইবার উপায় নাই। গৃহের এক কোণে একটি মেটে কলসী, কোণে একটি বহু টোল-খাওয়া নল-বাকা কলাইবিহীন বা স্বকৃত কর্দমের উপর কাৎ হইয়া পড়িয়া আছে। ১৬