এই মহৎ উদার যুবকের প্রতি তাঁহার (হরনাথ) মন আপনা হইতে নত হইয়া পড়িল। শ্রদ্ধায়, প্রীতিতে তাহার সমগ্র অন্তর্দেশ ভরিয়া উঠিল। তিনি উঠিয়া আবদুল্লাহকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, ভাই, তোমার মহত্ত্বের কাছে আজ আমি নতশিরে পরাজয় স্বীকার করছি। আজ হতে সত্যিই তুমি আমার ভাই।
আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের মৌল-বিষয় মুসলিমসমাজের জগদ্দল-প্রথা আর মিথ্যা সামন্ত আভিজাত্যের পতন-উন্মোচন এবং সে-সূত্রেই সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস-চরিত্রের উজ্জ্বল নির্মিতি। সৈয়দ সাহেবই এ-উপন্যাসের একমাত্র চরিত্র, যাকে ভালো-মন্দ মিলিয়ে রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয়। শরাফতী অভিমান, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অতিধার্মিকতা, মিথ্যা আভিজাত্যবোধ, অমিতচারিতা, খ্যাতি অর্জনের দুর্মর বাসনা এবং অর্থলোলুপতা–সবকিছু মিলে তিনি ধ্বংসোনুখ সামন্তসমাজের শেষ নিশ্বাস যেন। মীর হোসেন আলীর চরিত্র সৈয়দ সাহেবের বিপরীত প্রান্ত ধরে নির্মিত হয়েছে। সে সুদখোর, তাই প্রচলিত ধারণায় অধার্মিক–কিন্তু গভীরতর দৃষ্টিতে দেখলে সে অধার্মিক হয়েও মানুষ। ধার্মিক হলেই যে মানুষ শ্রদ্ধেয় হয় না, অথচ পুরোপুরি ধার্মিক না হলেও শ্রদ্ধেয় হতে পারে, এই দৃষ্টিকোণে চরিত্রদ্বয় চিত্রিত করে ইমদাদুল হক আধুনিক যুগের ঔপন্যাসিকদের সঙ্গে তার সাধর্মের পরিচয় দিয়েছেন।১১ দুটো চরিত্রের অন্তসত্তার দ্বন্দ্বের মাধ্যমে লেখক উপস্থাপন করতে চেয়েছেন মুক্তবুদ্ধির এক মৌল ধারণা, যা কাজী আবদুল ওদুদের ভাষ্যে–
যখন ভাবা যায়, রক্ষণশীল সৈয়দ সাহেবের প্রকাণ্ড ব্যক্তিত্ব, তার চারপাশের জগতের উপরে তার প্রভাব, আর সমাজে অপ্রিয় কিন্তু তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও বিচক্ষণ মীর সাহেবের অনাড়ম্বর কিন্তু সুনিশ্চিত সংস্কারপ্রয়াস ও তাতে অনেকখানি সাফল্য, তখন মনে হয় এই দুই ব্যক্তি অথবা দুই শক্তি আবদুল্লাহ-কারের তুলিকার প্রধান বিষয়, –আবদুল্লাহ্, আবদুল কাদের, রাবিয়া, হালিমা প্রমুখ মুসলিম নবীন-নবীনা হচ্ছেন বাংলার মুসলিমসমাজের এই দুই বিরুদ্ধশক্তির অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষজাত স্ফুলিঙ্গ। এই স্ফুলিঙ্গই অবশ্য ভবিষ্যতের অচঞ্চল আলোকের পূর্বাভাস।১২
আবদুল্লাহ উপন্যাসে নারী আছে, কিন্তু কোন নারী-চরিত্র নেই যারা ব্যক্তিত্বে-প্রেমে সংগ্রামে-সত্তায় সমুজ্জ্বল। কারণ একটাই, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম সমাজে নারীর ব্যক্তিত্ব-বিকাশের চরম অবরোধ। তবে এখানে লেখকের ব্যর্থতা ঢাকবার পুরোপুরি অবকাশ নেই, কারণ সালেহা-হালিমা বা রাবিয়ার বেশ কিছু পূর্বেই মোহাম্মদ নজিবর রহমানের (১৮৭৮-১৯২৩) শব্দস্রোতে আমরা পেয়েছিলাম ব্যক্তিত্বসচেতন আনোয়ারা চরিত্র–তারও ছিল একই সমাজপটভূমি।
দিগম্বর ঘোষ এবং হরনাথ চরিত্রের মাধ্যমে লেখক উপস্থিত করেছেন হিন্দু-সামন্তপ্রভুর মহাজনি শোষণের চিত্র। ইমদাদুল হকের শিল্পিমানসের মৌল-ধর্ম অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সে-সূত্রে আবদুল্লাহর পরেই এসেছে ডাক্তার দেবনাথ সরকার চরিত্র। দেবনাথ সকল ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানবিক গুণে জাগ্রত এক উদার মানুষ। এ-উপন্যাসে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক চেতনা উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে, কিন্তু লেখকের সাফল্য এখানেই যে, তিনি সচেতনভাবে তার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং আবদুল্লাহ্ ও দেবনাথ-চরিত্রের মাধ্যমে তার কেন্দ্রীয়বোধে জাগ্রত থেকেছেন।
কাজী ইমদাদুল হক বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক নন, তবে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের অন্যতম ধর্ম যে পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা–তা ছিল আবদুল্লাহ্-কারের করতলগত। পর্যবেক্ষণক্ষমতার সূক্ষ্মতায় ইমদাদুল হক ছিলেন শ্রেষ্ঠমানের শিল্পী এবং এ সূত্রেই এ-উপন্যাসে পরিপ্রেক্ষিতের চরিত্রসমূহের উজ্জ্বল নির্মিতি। ইমদাদুল হক যে ঔপন্যাসিকের প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন, এ-উপন্যাসে পরিপ্রেক্ষিতের চরিত্রগুলো দেখেই আমরা তা অনুধাবন করতে পারি। নিরাসক্ত দৃষ্টি দিয়ে তিনি এমন কতিপয় চরিত্র নির্মাণ করেছেন, সমকালীন মুসলিম কথাকোবিদদের রচনায় তার তুলনা মেলা ভার। ২৯ পরিচ্ছেদে আছে এমন একটি উজ্জ্বল নির্মাণ। আবদুল্লাহ্ প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে রসুলপুর স্কুলে। পল্লিগ্রামের রাস্তা বর্ষার অত্যাচারে গরুর গাড়ির জন্যে উপযুক্ত ছিল না, ফলে একস্থানে গাড়ি অচল হলো। রাস্তার পাশেই এক ব্রাহ্মণের বাড়ির উপর দিয়ে যাবার বিকল্প পথ ছিল। আবদুল্লাহ্ সে-চেষ্টা করতে গেলে উপন্যাসে ফুটলো সেই ক্ষণিকের উজ্জ্বল চরিত্র–
আবদুল্লাহ্ যথাশক্তি বিনয়ের ভাব দেখাইয়া কহিল, মশায়, আমি গরুর গাড়ি করে যাচ্ছিলাম, গ্রামের মধ্যে এসে দেখি রাস্তার এক জায়গায় ভাঙ্গা, গাড়ি চলা অসম্ভব। শুনলাম মশায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে একটা পথ আছে, যদি দয়া করে…
লোকটি রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, হ্যাঁ, তোমার গাড়ি চলে না চলে তা আমার কি? আমার বাড়ির উপর দিয়ে ত আর সদর রাস্তা নয় যে, যে আসবে তাকেই পথ ছেড়ে দিতে হবে…
আবদুল্লাহ্ একটু দৃঢ়স্বরে কহিল, মশায়, বিপদে পড়ে একটা অনুরোধ কত্তে এসেছিলাম, তাতে আপনি চটছেন কেন? পথ চেয়েছি বলে ত আর কেড়ে নিতে আসিনি। সোজা বল্লেই হয়, না, দেব না।