মোড়ল কহিল, তা নেন, কত্তা; কিন্তু ওগোরে দিন কতেক থাতি দেন…
এদিকে মদন দরজার সম্মুখে আড় হইয়া পড়িয়াই আছে। দিগম্বর ঘোষ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়া কহিলেন, ওঠ, নইলে তোকে ডিঙ্গিয়ে আমরা বাড়ির ভিতর ঢুকব…
এই কথায় আরো একজন প্রতিবেশী দয়াপরবশ হইয়া কহিল, ঘোষ মশাই, দখল তো আপনার হলই, তা এখন বাড়ির মদ্দি গে ওগোরে বেইজ্জত করে আর আপনাগোর লাভ কী হবে? এট্টু থামেন, আমরা মদন গাজীর পরিবারগোরে সরায়ে নে যাই। আপনারা যদি দোরডা এট্টু ছাড়েন, তয় আমরা বাড়ি খালি করি।
পেয়াদা তখন বলিয়া উঠিল, আরে, তোমরা সেই ফাঁকে জিনিসপত্তরগুলোও সরাও আর কি?
মদন উঠিয়া বসিয়া বলিয়া উঠিল, হায় হায় প্যাদাজী, জিনিসপত্তর কি কিছু আছে! কিছু নেই রে আল্লা কিছু নেই! বউডোর এট্টা বদনা ছিল, তাও আজ কদ্দিন হল বেচে খাইচি– ছাওয়ালডার জ্বর হল, কদ্দিন কাজে যাতি পাল্লে না, কচি বউডোরে কাঁদায়ে নিজিরগোর প্যাট্টা ভল্লাম–। বলিতে বলিতে বৃদ্ধের শ্বেত শ্মশ্রুজি বাহিয়া দরবিগলিতধারে অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।
এমন সময় বাড়ির ভিতর হইতে স্ত্রীলোকদিগের যুগপৎ ক্রন্দন এবং চিৎকার শোনা গেল। ব্যাপার কী জানিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া মদন তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাড়ির ভিতর যাইতেছিল, এমন সময় তাহার বৃদ্ধা স্ত্রী দরজার কাছে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতে করিতে কহিল, ওগো আল্লা গো, কী হবে গো আমার সাদেক গাঙ্গে ঝাঁপ দেছে গো, –ওরে আমার সোনার যাদু রে– ভিটেমাটি সব গেলে সেই দুঙ্কে আমার যাদু পানিতে ডুব দেছে রে আল্লা! হা হা হা হা…
এদিকে স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনিতে শুনিতে হতভাগ্য মদন দড়াম করিয়া আছাড় খাইয়া পড়িল। বাড়ির ভিতরে-বাহিরে একটা শোরগোল পড়িয়া গেল–এক দিক হইতে স্ত্রীলোকেরা অন্য দিক হইতে প্রতিবেশীরা ছুটিয়া দরজার কাছে আসিয়া দেখিল, বৃদ্ধ মদন চৌকাঠের উপর মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে।
.
০৮.
রসুলপুর গ্রামখানি বেশ বর্ধিষ্ণু। তথায় বহুসংখ্যক উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমান রইস্ বাস করেন। হিন্দুগণ প্রায় সকলেই সম্পন্ন গৃহস্থ কিন্তু মুসলমান রইসগণের অবস্থা ভালো নহে। তাহাদের অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি, এমনকি, কাহারো কাহারো বসতবাটীখানি পর্যন্ত রসুলপুরেরই হিন্দু মহাজনদিগের নিকট ঋণদায়ে আবদ্ধ; তথাপি তাহারা সাংসারিক উন্নতির জন্য কোনো প্রকার উদ্যোগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন না। একমাত্র খোদা ভরসা করিয়াই খোশ মেজাজে বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করিয়া থাকেন।
এতদ্ভিন্ন পলাশডাঙ্গা প্রভৃতি নিকটস্থ গ্রামগুলিতে অনেক মুসলমান কৃষক বাস করে। গ্রাম সন্নিহিত বিল এবং ক্ষেত্রগুলি প্রচুর উৎপাদনশীল হইলেও এই সকল হতভাগ্য কৃষকের অবস্থা সচ্ছল নহে। তাহারা যাহা কিছু উপার্জন করে, তাহার অধিকাংশই মহাজনেরা গ্রাস করিয়া বসে; অবশিষ্ট যাহা থাকে, তাহাতে কায়ক্লেশে বৎসরের অর্ধেককাল চালাইয়া বাকি অর্ধেকের খাওয়া-পরার জন্য ইহারা আবার মহাজনের হাতে-পায়ে ধরিতে যায়।
আবদুল্লাহর ফুফা মীর মোহূসেন আলি রসুলপুর গ্রামেরই একজন মধ্যবিত্ত রই। তিনি পৈতৃক সম্পত্তি যাহা পাইয়াছিলেন, তাহা সামান্য হইলেও পাটের করবারে এবং মহাজনিতে বেশ দু পয়সা উপার্জন করিয়া এখানে এ অঞ্চলের মধ্যে একজন ধনী লোক বলিয়া পরিচিত হইয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মীর সাহেব গৃহশূন্য এবং নিঃসন্তান। লোকে বলিত স্বামী সুদ খান বলিয়া পীরের মেয়ে মনের দুঃখে সংসার ছাড়িয়া গিয়াছেন এবং সুদের গোনায় আল্লাহতালা মীর সাহেবকে সংসারের সুখ হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন।
কিন্তু মহাজনি কারবারে মীর সাহেব নিজগ্রাম অঞ্চলে বড় একটা সুবিধা করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাহার খাতকের প্রায় সকলেই ভিন্ন গ্রামের এবং তাহাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী মুসলমান। মীর সাহেবের নিকট অনেক কম সুদে টাকা পাইত বলিয়া তাহারা ফি মৌসুমে তাহার নিকট হইতে আবশ্যকমতো টাকা ধার লইত এবং মৌসুমে যথেষ্ট লাভ করিয়া মীর সাহেবের কড়া গণ্ডা বুঝাইয়া দিয়া যাইত।
মধ্যবিত্ত মুসলমান রইস্ যাহাদের একটু আধটু ভূ-সম্পত্তি আছে এবং দরিদ্র মুসলমান কৃষক, গ্রাম্য মহাজনের পক্ষে এই দুই শ্রেণীর লোকের মধ্যে টাকা খাটাইবার যেমন সুবিধা, এমন আর কোথাও নাই। রসুলপুর অঞ্চলে এই শ্রেণীর লোক যথেষ্ট থাকাতে হিন্দু মহাজনেরা বেশ ফাঁপিয়া উঠিতেছেন; কিন্তু তাহার সুদের হার অতি সামান্য হইলেও মীর সাহেব তাহাদের মধ্যে দুইটি কারণে ব্যবসায় জমাইতে পারেন নাই। প্রথমত, রইসগণের প্রায় সকলেই তাহার জ্ঞাতি-কুটুম্ব; সুতরাং তাহার পরম হিতৈষী। কাজেই হিন্দু মহাজনদিগের নিকট হইতে উচ্চ হারের সুদে ঋণ গ্রহণ করিয়া জেরবার হইতেছেন, তথাপি মীর সাহেবকে মহাজনি কারবারে প্রশ্রয় দিয়া তাহাকে জাহান্নামে পাঠাইতে তাহাদের প্রবৃত্তি হইতেছে না। দ্বিতীয়ত, পূর্বপুরুষগণের মনিব বলিয়া কৃষকমহলে রইগণের আজ পর্যন্ত যে প্রভুত্বটুকু টিকিয়া ছিল, তাহারই বলে তাহারা তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিয়াছেন যে, মুসলমান হইয়া যে ব্যক্তি সুদ খায়, সে জাহান্নামী এবং সে জাহান্নামীর সঙ্গে মুসলমান হইয়া যে কারবার করে সেও জাহান্নামে যায়। এই জন্যেই তো সুদখোরের বাড়িতে খাওয়া অথবা তাহাকে বাড়িতে দাওৎ করিয়া খাওয়ানো মস্ত গোনার কাজ। কিন্তু হিন্দুদের যখন ধর্মে বাধে না, তখন সুদ খাইলে তাহাদের কোনো পাপ নাই, সুতরাং লাচারী হালেতে তাহাদের সঙ্গে কারবারেও কোনো দোষ হইতে পারে না।