এদিকে কিছুদিন হইতে মদনের বসতবাটীখানির ওপর ঘোষ মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান জনার্দন ঘোষের লোলুপ দৃষ্টি পড়িয়া আছে। বাড়িখানি বেশ উচ্চভূমির উপর নির্মিত, এবং তাহার সহিত কয়েক বিঘা বাগানের উপযুক্ত জমিও আছে। স্থানটিও বেশ নির্জন–চারিদিকে যদিও মুসলমান কৃষক বস্তি তথাপি অন্তত যখন সেখানে কোনো ভদ্রলোকের বসতি নাই, তখন স্থানটি একটি সুন্দর বাগানবাড়ির জন্য উপযুক্তরূপ নির্জন বলিয়াই মনে করা যাইতে পারে। পিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির উপর ঘরে বসিয়া যদৃচ্ছা আমোদ-প্রমোদ করা চলে না; তাই একটি বাগানবাড়ি নির্মাণ করিবার জন্য এইরূপই একটি নির্জন প্রশস্ত স্থানের অভাব জনার্দন বাবু অনেক দিন হইতে বোধ করিয়া আসিতেছেন। এক্ষণে পলাশডাঙ্গা এবং রসুলপুরের মধ্যে একটা নদীর ব্যবধান থাকায়, এই গ্রামটিই বাগানবাড়ি নির্মাণের উপযুক্ত বলিয়া তিনি স্থির করিয়াছেন। মদনের বাড়িখানিও ঠিক নদীর উপরেই; সুতরাং গোপন বিহারের জন্য এরূপ নিরাপদ স্থান আর কোথায় পাওয়া যাইবে? সুতরাং মদনের নামে নালিশ করিয়া উহার। বাড়িখানির দখল লইবার জন্য তিনি কিছুকাল যাবৎ পিতাকে বারবার তাগাদা করিতেছেন। আর ঘোশ মহাশয়ই-বা কতকাল খতখানি ফেলিয়া রাখিবেন? সুতরাং আবার নালিশ হইল। ঘোষ মহাশয় দস্তুরমাফিক ডিক্রি পাইলেন।
এক্ষণে সেই ডিক্রির বাবদে ঘোষ মহাশয় বহু লোকজনসহ মদনের ভিটাবাড়িতে বাঁশগাড়ি করিতে আসিয়াছেন।
মদন আসিয়া ঘোষ মহাশয়ের পায়ের উপর আছাড় খাইয়া পড়িল এবং কহিতে লাগিল, দোহাই বাবু, আমারে এক্কেবারে পথে দাঁড়া করাবেন না বাবু, আপনার পায়ে পড়ি বাবু…
ঘোষ মহাশয় পা টানিয়া কহিলেন, তা আমি কী করব বাপু; তুই টাকাটা এদ্দিন ফেলে রাখলি, যদি কিছু কিছু করে দিয়ে আসৃতিস, তোরও গায়ে লাগত না, আমারও খত তামাদি হত না। খত ফেলে রেখে তো আর আমি টাকাটা খোওয়াতে পারিনে।
মদন কাদিতে কঁদিতে কহিল, বললে বিশ্বাস করবেন না বাবু, আমি দুবেলা দুমুঠো ভাতই জোটাতে পারিনে, পরিবারের পরনে কাপড় দিতে পারিনে, কতে আপনার টাকা দেব…
দিগম্বর ঘোষ ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, হা, ওসব মায়াকান্না রেখে দে! কেন, তোর জোয়ান ব্যাটা রয়েছে, দুই বাপ-পোয়ে তো জন খেটে পয়সা রোজগার করিস–আবার বলে কিনা (মুখ ভ্যাংচাইয়া) দুমুঠো ভাত জোটাতে পারিনে পরিবারের কাপড় দিতে পারিনে!…
মদন কহিল, হায়, হায়, বাবু দ্যাহেন তো বুড়ো হয়ে গিছি, তাতে আজ বছরখানেতে হাঁপানি ব্যারামে এক্কালে কাবু হয়ে পড়িছি–কাজ কত্তি আর পারি নে। একলা ওই ছাওয়ালডা খাটে খাটে আর কত রোজগার কত্তি পারে বাবু? খানেআলা তো এট্টা দুডো না, কেমন করে যে সবগুলোর জান্টা বেঁচে আছে, তা আল্লাই জানে…
নে নে, এখন ওসব প্যান্প্যানানি রাখ। আমার টাকা তো আদায় করতে হবে…।
একান্ত প্রাণের দায়ে মরিয়া হইয়া মদন কহিল, তবে আর কয়ডা দিন রেহাই দেন। কত্তা, আমি এবার না খায়ে, না দায়ে আপনার টাকা কিছু কিছু করে দেব…
ঘোষ মহাশয় অবজ্ঞাভরে কহিলেন, হাঃ, তুই এতদিন বড় দিতে পাল্লি, এখন আবার দিবি! শুধু কথায় কি আর চিড়ে ভিজে রে, মদন!
তবে আমার কী উপায় হবে বাবু–কনে গে দাঁড়াব সব কাচ্চা বাচ্চা নে!
তা আমি কী জানি! তোর যেখানে খুশি সেইখানে যা–এখন এ বাড়ি আমার, আমি দখল করেছি।
এই কথায় মদন আর স্থির থাকিতে পারিল না। উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, ওগো আপনারা পাঁচজন আছেন, এট্টুখানি দয়া করে ওনারে দুটো কথা কয়ে আমারে বাঁচান। গো, আমারে বাঁচান, এ বাপদাদার ভিটেটুকখানি গেলি আমি কম্নে গে দাঁড়াব–হায় রে আল্লা! আমি কম্নে গে দাঁড়াব!
বিরক্ত হইয়া জনার্দন বাবু পেয়াদাকে ডাকিয়া কহিলেন, –নেও, তোমরা বাঁশটা গেড়ে ফেল! এই ব্যাটারা, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাজা, ঢোল বাজা!
দমাদম ঢোলে ঘা পড়িতে লাগিল। মদনের মনে হইল, যেন সে ঘা তাহার বুকের ভিতরই পড়িতেছে। সে আবার ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। এদিকে ঘোষ মহাশয় তাহার লোকজন লইয়া তাহার গৃহে প্রবেশ করিতে যাইতেছেন দেখিয়া সে দরজার সম্মুখে আড় হইয়া কহিল, আমার গলায় পা দে দমড়া বার করে ফেলে দেন কত্তা। আমার জানে আর এ সয় না গো, আমার জানে আর সয় না! হায় রে আল্লাহু, আমি কাচ্চা-বাচ্চা বউ ঝি নিয়ে কমে গে দাঁড়াব–ওগো আপনারা দয়া করে আমার হয়ে বাবুকে দুটো কথা কগে! আমার ঝি-বউরে পথে বার করবেন না গো বাবু, এট্টু দয়া করেন বাবু! আমি যে তাগোরে কারো বাড়ি ধান ভানতিও যাতি দেই নি। তাগোর মান-ইজ্জত মারবেন না, হা হা হা!…
পাড়ার একজন মোড়ল এ দৃশ্য আর দেখিতে না পারিয়া দিগম্বর ঘোষের দিকে একটু অগ্রসর হইয়া কহিল, কত্তা বুড়ো মানুষ ডুকরে কাঁদতি লেগেছে, এট্টু দয়া করেন–ওগোরে পথে বের করবেন না…
জনার্দন বাবু রুখিয়া উঠিয়া কহিলেন, ও ব্যাটার কান্নাতেই আমাদের খতের টাকা পরিশোধ হবে নাকি?
মোড়ল মিনতি করিয়া কহিল, না বাবু, আমি সে কথা কই নি। এক্ষণি ওগোরে বাড়ি হতি তাড়াবেন না তাই কই। কিছুদিন সোমায় দিলি ও আপনার এট্টা মাথা গোঁজবার জাগা করে নিতে পারবে…
পাছে বাগানবাড়ির পত্তন করিতে বিলম্ব হইয়া পড়ে, এ ভয়ে জনার্দন বাবু অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, না না, ওসব হবে টবে না বাপু। আমরা আজই দখল নেব।