আবদুল্লাহ্ বইখানি পড়ে আমি খুশি হয়েছি–বিশেষ কারণে, এই বই থেকে মুসলমানের ঘরের কথা জানা গেল। এদেশের সামাজিক আবহাওয়া-ঘটিত একটা কথা এই বই আমাকে ভাবিয়েছে। দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে, সেই অন্ধতাই চাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। এ কি মাটির গুণ? এই রোগবিষে ভরা বর্বরতার হাওয়া এদেশে আর কতদিন চলবে? আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলব? লেখকের লেখনীর উদারতা বইখানিকে বিশেষ মূল্য দিয়েছে।
আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে ইমদাদুল হক ব্যক্তিচরিত্র অপেক্ষা সমাজমানসের প্রতি অধিক মনোযোগী ছিলেন; ফলে উপন্যাসের যে অন্যতম শর্ত চরিত্রসৃজন, তা থেকে গেছে গৌণ, কখনো-বা অবহেলিত-উপেক্ষিত। মানবচিত্তের মূল প্রবৃত্তিগুলির দ্বন্দ্বে মানুষ কত অসহায়–এই চিরন্তন সত্যের রূপ-অঙ্কনে কাজী সাহেব যতটা নজর দেননি, তার চেয়ে বেশী তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে গ্রাম-বাংলার মুসলমানদের বিশেষ সমাজ ও বিশেষ কালের ছবি আঁকার দিকে। শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪) উপন্যাসসমূহ যেমন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে হিন্দু বঙ্কিমচন্দ্রের কঠোর শাসনে; তেমনি শিল্পী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ্ বরাবর নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সমাজের গলদ-প্রদর্শক একজন সমাজসংস্কারক ইমদাদুল হকের অদৃশ্য নির্দেশে। ফলে একটি মহাকাব্যিক পটকে স্পর্শ করেও ইমদাদুল হক ব্যর্থ হয়েছেন শৈল্পিক সিদ্ধি অর্জনে। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বিষাদ-সিন্ধু (১৮৯১) আর আনোয়ারার (১৯১৪) পরে। আবদুল্লাহ্-র জাগরণকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি একটা বিশেষ সময়ের মুসলিমমানসের। শিল্পিত ভাষ্য হিসেবেই।
সফল হোক বা না-ই হোক, তবু আবদুল্লাহ-ই এ-উপন্যাসের নায়ক। তাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের ঘটনাক্রম আবর্তিত হয়েছে, ধরা যায় তাকে সমস্ত ঘটনার যোগসূত্র হিসেবেই–তবু তার কোন ভূমিকাই নায়কোচিত নয়। প্রথম আবির্ভাবে তাকে যেমনটি দেখেছি, উপন্যাসের অন্তিমলগ্নেও সে তেমনি থেকে গেছে, ভোগেনি একবারও অন্তর্দ্বন্দ্বে; সমস্ত বিপর্যয়ের মুখে সে সব সময়ই যেন যুধিষ্ঠির। প্রথম থেকেই আবদুল্লাহ্ সম্পূর্ণাঙ্গ চরিত্র, তার কোন উদ্ভব নেই, বিকাশ নেই, নেই কোন পরিণতি। আবদুল্লাহ যেন ইমদাদুল হকের মানস-আকাঙ্ক্ষার শিল্প-মূর্তি ইমদাদুল হকের মতোই সংযতবাক, অচঞ্চলচিত্ত ও আদর্শনিষ্ঠ এক শিক্ষাব্রতী।
এতসব সীমাবদ্ধতা ধারণ করেও, আবদুল্লাহ্ এই অর্থে অনন্য ভাস্বর চরিত্র যে, সে-ই নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তমানসের প্রথম শিল্প-সন্তান। রক্ষণশীলতার দুর্গ সৈয়দ সাহেব আর প্রগতিমুখী মীর সাহেবের চৈতন্যের সংঘাত-সংঘর্ষে আবদুল্লাহ্ তৃতীয় মাত্রা নিয়ে বুর্জোয়া মানবতাবাদের ধারক হয়ে উঠতে চেয়েছে–কূপমণ্ডুকতা-পীরপ্রথা-ধর্মপ্রথা আর পাথরচাপা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। তাই অভীকচিত্তে সে বলতে পেরেছে এমন কথা–
ক. তাদের (হিন্দুদের) আছে বলেই যে আমাদের সেটা থাকতে হবে, এমন ত কোনো কথা নেই, আম্মা! আর এই পীর-মুরীদি ব্যবসায়টা হিন্দুদের পুরুতগিরির দেখাদেখিই শেখা, নইলে হযরত ত নিজেই মানা করে গেছেন, কেউ যেন ধর্ম সম্বন্ধে হেদায়েত করে পয়সা না নেয়।
খ. অত শরীয়তের ধার ধারিনে ভাই সাহেব; এইটুকু বুঝি যে মানুষের সুখ-সুবিধারই জন্য শরা-শরীয়ত জারি হয়েছে; বে-কায়দা কালে-অকালে কড়াকড়ি করে মানুষকে দুঃখ দেবার জন্যে হয়নি।
গ. খোদার উপর অবিশ্বাস দেখলে কোন্খানে? সংসারে উন্নতির চেষ্টা না করে কেবল হাত পা কোলে করে বসে থাকলেই যদি খোদার উপর বিশ্বাস আছে বলে ধরতে চাও, তবে আমি স্বীকার করি, আমার তেমন বিশ্বাস নেই।
আবদুল্লাহ্ পীরপ্রথা আর কুসংস্কারপ্রিয়তাকে প্রায়শই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে যেমন জর্জরিত করেছে, তেমনি উচ্চারণ করেছে অসাম্প্রদায়িক মানস-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন দেখেছে একটি নতুন সমাজের। বরিহাটীর স্কুল থেকে বিদায়-লগ্নে ছাত্রদের উদ্দেশে তার বক্তব্য মুসলিম মধ্যবিত্তের অসাম্প্রদায়িক জীবনদৃষ্টিকে যেমন প্রকাশ করেছে, তেমনি এর মধ্য দিয়েই ইমদাদুল হকের মৌল-আকাঙ্ক্ষাও অভিব্যঞ্জিত হয়েছে–আশীর্বাদ করি, তোমরা মানুষ হও, প্রকৃত মানুষ হও–যে মানুষ হলে পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা কত্তে ভুলে যায়, হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে আপনার জন বলে মনে কত্তে পারে। এই কথাটুকু তোমরা মনে রাখবে ভাই, –অনেকবার তোমাদের বলেছি, আবার বলি, হিন্দু-মুসলমানে ভেদজ্ঞান মনে স্থান দিও না। আমাদের দেশে যত অকল্যাণ, যত দুঃখ-কষ্ট, এই ভেদজ্ঞানের দরুনই সব। এইটুকু ঘুচে গেলে আমরা মানুষ হতে পারব দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারব।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মুসলিম মধ্যবিত্তমানসের মৌল-লক্ষণ সমাজবিচ্ছিন্ন স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং একই সাথে সমাজ-সংশ্লিষ্ট কর্মচেতনা আবদুল্লাহ্ চরিত্রের মধ্য দিয়ে শিল্পমূর্তি লাভ করেছে। আবদুল্লাহ্ তার দৃষ্টিকে সমাজ-অঙ্গন থেকে কখনো ব্যক্তিলোকে নিয়ে আসতে পারেনি ফলে সমাজস্রোতে ভাসমান ব্যক্তি-আবদুল্লাহর কোনই সংরাগ অনুরাগ–সংবেদনা আমাদের কাছে ধরা দেয়নি। সে সব সময় ভালো থেকে গেছে, খুব ভালো এবং শেষ পর্যন্ত এক ভালোমানুষ হিসেবেই নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্বে সে জয়ী হয়েছে– স্রষ্টা যেন নিজের মানসইচ্ছাকে আবদুল্লাহর মাধ্যমে শিল্পমূর্তি দান করেছেন। তাই উপন্যাসের অন্তিমলগ্নে হরনাথের দৃষ্টিকোণে লেখক উচ্চারণ করেছেন এমন কথা–