এইরূপ বহুবিধ উপদেশের মধ্য দিয়া খানা শেষ হইল, আবদুল্লাহ একবার মনে করিয়াছিল, তাহার পড়াশুনার কথাটা এই সময়ে পাড়িয়া দেখিবে, কিন্তু আবার ভাবিল, না, এখন ও-সব কথা পাড়িয়া কাজ নাই। কাল দিনের বেলা সুবিধামতো নিরিবিলি পাইলে তখন। বলা যাইবে। বিশেষত এতগুলি লোকের সামনে তাহার মুখ ফুটিল না; তাহার আত্মসম্মান। অন্তরের মধ্য হইতে তাহাকে বাধা দিতে লাগিল।
.
০৭.
পলাশডাঙ্গার মদন গাজীর বাড়িতে আজ মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছে। তাহার ভয়ানক বিপদ উপস্থিত। মহাজন দিগম্বর ঘোষ পেয়াদা এবং বহু লোকজন লইয়া আজ তাহার বসতবাড়িতে বাশগাড়ি করিতে আসিয়াছেন। পাড়ার লোকজনে তাহার বাহিরবাড়ি পরিপূর্ণ, সকলেই। বেচারার ঘোর বিপদে সহানুভূতি ও দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। কিন্তু এ বিপদ হইতে মদন গাজী কিসে উদ্ধার পাইতে পারে তাহা কেহই স্থির করিতে পারিতেছে না।
মদনের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। তাহার খামার জমিগুলির মত উর্বরা জমি এ অঞ্চলে আর কাহারো ছিল না। গোলাভরা ধান, গোয়াল-ভরা গরু, ছালল এবং উঠান-ভরা মোরগ-মুরগি লইয়া সে বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে দিনপাত করিত। তাহার জমিতে পাটও জন্মিত এবং তাহা হইতে রাশি রাশি কাঁচা টাকা পাইয়া সে কৃষকমহলে খাতির যথেষ্ট জমাইয়া তুলিয়াছিল। কাজেই জ্যেষ্ঠপুত্র সাদেকের বিবাহের সময় পাঁচজন জ্ঞাতি-কুটুম্ব একত্র হইয়া ধরিয়া বসিল, খুব ধুমধাম করা চাই, দু-চারখানা গ্রামের লোক খাওয়াইতে হইবে, বাজি বাজনা, জারি-কবি, এসবের বন্দোবস্ত করিতে হইবে, নহিলে শুধু মদন গাজীর কেন, পলাশডাঙ্গার শেখেদের কাহারো মান থাকিবে না। শেখেরা তো আর এখন আগেকার মতো মিঞা সাহেবদের গোলামি করে না। মদন গাজীর মতো মাথা–তোলা লোকও মিঞা সাহেবদের মধ্যেই-বা কটা আছে? এবার দেখানো চাই শেখেরাও মিঞাদের মতো ধুমধাম করিতে জানে, ইত্যাদি।
প্রথমটা মদনের এসবে বড় মত ছিল না; কিন্তু পাঁচজনের উৎসাহে সেও নাচিয়া উঠিল। পুত্রের বিবাহে বিস্তর টাকা ব্যয় করিয়া ফেলিল। সুতরাং বেশ রকমের একটা দেনাও তাহাকে ঘাড় পাতিয়া লইতে হইল। আর মদনের মতো সম্পন্ন গৃহস্থকে কেই-বা না বিনা বাক্যব্যয়ে টাকা ধার দিবে। রসুলপুরের দিগম্বর ঘোষ যদিও ভারি কড়া মহাজন–তাহার সুদের হারও যেমন উঁচু আদায়ের বেলাও তেমনি কড়াক্রান্তি পর্যন্ত কোনো দিন রেয়াত করে না। তবু এক্ষেত্রে তিনি পরম আগ্রহের সহিত খামারগুলি রেহেন রাখিয়া কম সুদেই মদনকে টাকা ধার দিয়া তাহাকে মস্ত খাতির করিয়া ফেলিয়াছেন। তাই পাঁচজনে বলিল, ও দেনার জন্য কিছু ভয় নেই মদন। খোদা তোমাকে যেমন দিতে আছেন, তাতে ওই কটা টাকা পরিশোধ কত্তি আর কদ্দিন? মদন আশায় বুক বাঁধিল, পিতাপুত্রে দ্বিগুণ উৎসাহে আবার ক্ষেতের কাজে লাগিয়া গেল।
মদনের খামার জমিগুলির ওপর অনেকেরই লোভ ছিল; কিন্তু এ যাবৎকাল কেহই তাহাতে হাত দিবার সুযোগ পান নাই। এবারে যখন সে হতভাগ্য ঘোষ মহাশয়ের কবলে পতিত হইল, তখন তিনি মনে মনে বেশ একটুখানি প্রীতি অনুভব করিলেন, তাহার পর দুই তিন বৎসর ধরিয়া যখন ক্রমাগত অজন্মা হইতে লাগিল, এবং মদনের দেয় সুদ কিস্তির পর কিস্তি বাকি পড়িয়া চক্রবৃদ্ধিহারে ক্রমাগত বাড়িয়া চলিল, তখন ঘোষ মহাশয় ভাবিলেন, আর যায় কোথায়!
ফলে ঘটিল তাহাই। টাকা আর পরিশোধ হইল না। তিন বৎসরের অজন্মার পর চতুর্থ বৎসরে যখন সুপ্রচুর ফসল জন্মিবার সম্ভাবনা দেখা গেল, তখন মদনের আশা হইল যে, খোদায় করিলে এবার মহাজনের টাকা পরিশোধ করিতে পারিবে। কিন্তু ওদিকে ঘোষ। মহাশয়ের সজাগ দৃষ্টি ফসলের প্রাচুর্যের দিকে পতিত হইয়া তাহাকে একটু ব্যস্ত করিয়া তুলিল–পাছে মদন ঋণ পরিশোধ করিবার সুযোগ পাইয়া বসে, এই ভয়ে তিনি তামাদির অজুহাতে তাড়াতাড়ি নালিশ করিয়া দিলেন। মদন প্রচুর ফসলের সম্ভাবনার কথা বলিয়া সময় প্রার্থনা করিল, কিন্তু সে সময়ে তাহার হাতে নগদ টাকা ছিল না, সহসা কাহারো নিকট ধারও পাওয়া গেল না। কাজেই তদ্বিরের অভাবে বিশেষত ওপক্ষের মুক্তহস্ত তদ্বিরের মুখে সে তাহার ক্ষীণ প্রার্থনা গ্রাহ্য করাইতে পারিল না। মদনের খামার জমিগুলি নিলাম হইয়া গেল, এবং ঘোষ মহাশয় সেগুলি খরিদ করিয়া ফেলিলেন। আর একটু বিশেষ রকম তদ্বিরের ফলে সমস্ত খামার জমিগুলি নিলাম হইয়াও কতক টাকা বাকি রহিয়া গেল। মদন সেই টাকার দরুন আবার বসতবাটী রেহেন দিয়া নূতন খত লিখিয়া দিল এবং সে যাত্রা নিষ্কৃতি পাইল।
কিন্তু খামারগুলি হারাইয়া এক্ষণে তাহার পক্ষে সেই নূতন খতের টাকা পরিশোধ করা আরো অসম্ভব হইয়া পড়িল। এখন তাহার পেট চালানোই দায়; পরিবারের লোক তো কম নয়, –দুবেলা তাহাদের সকলের পেট ভরিয়া আহার জোটে না, পরিবারের পরনে কাপড় এক প্রকার নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ঘরের জিনিসপত্র একে একে সব গিয়াছে। তবু মদন জোয়ান ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া পাড়ায় জন-মজুরি করিয়া কোনোক্রমে পরিবারগুলিকে অনশন হইতে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে–কিন্তু এ যাবৎ একটি পয়সা সুদ দিয়া উঠিতে পারে নাই। ক্রমে অর্ধাশনক্লেশ এবং তাহার ওপর দারুণ ভাবনায় তাহার শরীর একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে।