কেন জুটবে না? খোদার উপর তওয়াল রাখলে নিশ্চয়ই জুটবে।
ঘরে বসে খালি খোদার উপর তওয়াল রাখলে তো আর অমনি ভাত পেটের ভিতর ঢুকবে না। তার জন্যে চেষ্টা করতে হবে ও যাতে দু পয়সা উপায় হয় তার জন্যে খাটতে হবে। যে দিন-কাল পড়েছে, তাতে ইংরেজি না শিখলে আর সেটি হবার যো নেই…।
কেন কত লোক যে ইংরেজি শেখে নি, খোদা কি তাদের ভাত-কাপড় জুটিয়ে দিচ্ছেন না?
তর্ক আবার অপ্রিয় হইয়া উঠিবার উদ্যোগ করিতেছে দেখিয়া আবদুল্লাহ্ কহিল, যা গে যাক্, ও-সব কথা তোমরা বুঝবেও না, ও-তর্কেও আর কাজ নেই…
না, আমরা বুঝিও নে, বুঝতে চাইও নে; কেবল এইটুকু জানি যে, খোদার উপর তওয়াল রাখলে আর তার কাজ রীতিমতো করে গেলে, কারুর কোনো ভাবনা থাকে না। আব্বা যে বলে থাকেন, ইংরেজি পড়লে খোদার উপর আর লোকের তেমন বিশ্বাস থাকে না, তা দেখছি ঠিক।…
শেষটা তাহার নিজের উপরই প্রযুক্ত হইল বুঝিয়া আবদুল্লাহ্ একটু বিরক্তির স্বরে কহিল, খোদার উপর অবিশ্বাস দেখলে কোন্খানে? সংসারে উন্নতির চেষ্টা না করে কেবল হাত-পা কোলে করে বসে থাকলেই যদি খোদার উপর বিশ্বাস আছে বলে ধরতে চাও, তবে আমি স্বীকার করি, আমার তেমন বিশ্বাস নেই।
স্বামীর মুখে এত বড় নাস্তিকতার কথা শুনিয়া সালেহা একেবারে শিহরিয়া উঠিল। সে। দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, এ্যাঁ, বলেন কী! তওবা করুন, তওবা করুন, অমন কথা মুখ দিয়ে বার করবেন না! ওতে কত বড় গোনাহ্ হয়, তা কি আপনি জানেন না? ও-কথা যে শোনে সেও জাহান্নামে যায়।…
এমন সময় মসজিদে এশার নামাযের আযান আরম্ভ হওয়ায় আবদুল্লাহ্ চুপ করিয়া রহিল। আযান শেষে মুনাজাত করিয়া কহিল, জাহান্নামে যাবার ভয় থাকে তো তোমার আর ওসব শুনে কাজ নেই।
এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ একটা বালিশ টানিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল।
সালেহা কহিল, এখন শুলেন যে? নামায পড়তে যাবেন না?
না, আর মসজিদে যাব না, ঘরেই পড়ব এখন; একটু গড়াগড়ি দিয়ে নিই। বড় হয়রান হয়ে এসেছি।
তবে আমি যাই, নামাযটা পড়ে নিয়ে খানার যোগাড় করি গিয়ে–
তা হলে দেখছি খাওয়াদাওয়ার এখনো ঢের দেরি আছে–ততক্ষণে আমি নামায পড়ে বেশ একটা ঘুম দিয়ে নিতে পারব। তুমি এক বদনা ওযুর পানি পাঠিয়ে দিও
এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ চৌকির উপর পড়িয়া পড়িয়া একটা বিকট হাই তুলিয়া সাড়ম্বরে আলস্য ত্যাগ করিল।
সালেহা একটা বাঁদীকে ডাকিয়া পানি দিতে বলিয়া চলিয়া গেল।
হালিমা ও সালেহার চেষ্টায় সেদিন একটু সকাল সকাল খানার বন্দোবস্ত হইল। তখন। রাত্রি দ্বিপ্রহর পার হইয়া গিয়াছে।
একটা বাঁদী আসিয়া আবদুল্লাহকে ডাকিয়া তাহার শ্বশুরের ঘরে লইয়া গেল। দস্তরখান সেইখানেই বিছানো হইয়াছিল। আবদুল্লাহ্ ঘরে প্রবেশ করিতেই শ্বশুর কহিলেন, এস বাবা, এস, ভালো আছ তো?
আবদুল্লাহ্ শ্বশুরের কদমবুসি করিয়া কহিল, জি হাঁ, ভালোই আছি। হুজুরের তবিয়ত কেমন?
শ্বশুর একটু কাতর স্বরে কহিলেন, আর বাবা তবিয়ত! এবার নিতান্তই খোদার মরজিতে আর হুজুরের (অর্থাৎ পীর সাহেবের) দোয়াতে বেঁচে উঠেছি, নইলে বাচবার আশা ছিল না। এখনো চলতে পারি নে, হাত-পা কাপে।
আবদুল্লাহ্ কহিল, তা এই দুর্বল শরীরে রাত্রে একটু সকাল সকাল খেয়ে নিলে বোধ করি ভালো হয়…
আর বাবা, ওটা অভ্যেস হয়ে গেছে–তা ছাড়া নামাযটা না পড়ে কেমন করে খাই। খেলে যে আর শুয়ে পারি নে…
এমন সময় বাঁদীরা বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে নিদ্রা হইতে উঠাইয়া টানিতে টানিতে আনিয়া দস্তরখানে একে একে বসাইয়া দিয়া গেল। বেচারারা বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে লাগিল। কর্তার বাঁদী-পুত্র খোদা নেওয়াজ দস্তরখানের উপর বাসন-পেয়ালা প্রভৃতি সাজাইতে সাজাইতে একটা বাঁদীকে ডাকিয়া কহিল, ওরে ফুলি, বড় মিঞা সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়।
আবদুল কুদ্দুস প্রথম বয়সে একটি বাঁদীকে নিকাহ্ করিয়াছিলেন, তাহারই গর্ভে খোদা নেওয়াজের জন্ম হয়। খোদা নেওয়াজই তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র; কিন্তু সে বাঁদী-গর্ভজাত বলিয়া বিবি-গর্ভজাত কনিষ্ঠ ভ্রাতাদিগকে বড় মিঞা সাহেব, মেজ মিঞা সাহেব ইত্যাদি বলিয়া ডাকিতে হয়। সংসারে যে তাহাকে ঠিক চাকরের মতো থাকিতে হয়, এরূপ বলা যায় না; কেবল মসজিদ এবং দস্তরখানে খাদেমি এবং অন্দরের ও সদরের ফুট-ফরমাইশ খাটা ভিন্ন তাহার আর বড় একটা কাজ ছিল না। অবশ্য তাহার আহারাদি যে চাকর-মহলেই হইত, তাহা বলাই বাহুল্য।
বড় মিঞা সাহেব তাহার বহির্বাটীস্থ মহল হইতে অন্দরে আনীত হইলে খান আরম্ভ হইল। কর্তা আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, তোমার ওয়ালেদ মরহুমের সঙ্গে আমার একবার শেষ দেখাটা হল না, সেজন্যে আমার জানে বড় সমা লেগেছে। বড় ভালো লোক ছিলেন তিনি, এমন দীনদার পরহেজগার লোক আজকালকার জমানায় বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না। কী করব, বাবা, সবই কিসমত? তা তোমার আম্মা ভালো আছেন তো?
জি না, তেমন ভালো আর কোথায়! আব্বার এন্তেকালের পর থেকে তারও তবিয়ত খারাব হয়ে পড়েছে।
তা তো পড়বেই বাবা, তাঁর ধড়ে কি আর জান আছে! এর চেয়ে সদমা আর দুনিয়াতে নেই। ওঁয়ার শরীরটার দিকে একটু নজর রেখো বাবা, আর এ সময় তুমি কাছে কাছেই থেকো, ওয়াকে একলা ফেলে কোথাও গিয়ে বেশি দিন থেকো না, এ-সময়ে তুমি কাছে থাকলে ওঁর মনটা একটু ভালো থাকবে।…