ইতোমধ্যে সালেহা আবদুল্লাহর বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। তাহার স্বামী এইরূপ অভ্যর্থনা চান বটে; কিন্তু সে কদমবুসির পরিবর্তে এরূপ বেহায়াপনার দ্বারা স্বামীর অভ্যর্থনা করা মোটেই পছন্দ করিত না। সে ভাবিত, তাহার স্বামী তাহাকে একটা বৃহৎ কর্তব্যকর্মে বাধা দিয়া কাজ ভালো করেন না।
ছাড়ুন ছাড়ুন, কেউ দেখতে পাবে বলিয়া সালেহা স্বামীর সাগ্রহ বাহুবেষ্টন হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া সরিয়া দাঁড়াইল। একটু পরে আবার কহিল, আপনি বড় অন্যায় করেন।
আবদুল্লাহ্ চৌকির উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী অন্যায় করি?
চৌকির অপর প্রান্তে উঠিয়া বসিতে বসিতে সালেহা কহিল, এই–এই–সালাম করতে দেন না আর কি! ওতে যে আমার গোনাহ্ হয়।
যদি গোনাহ্ হয়, তবে সে আমারই হবে, কেননা, আমিই করতে দেই না।
আপনার হলে তো আমারও হল–
আবদুল্লাহ্ একটু বিদ্রুপের স্বরে কহিল, বাঃ, বেশ ফতোয়া জারি করতে শিখেছ যে দেখছি!
পানের বাটাটি স্বামীর সম্মুখে বাড়াইয়া দিয়া সালেহা কহিল, ফতোয়া আবার কোথায় হল?
বাটা হইতে দুটি পান তুলিয়া মুখে দিয়া চিবাইতে চিবাইতে আবদুল্লাহ্ কহিল, কেন, এই যে বললে, একজনের গোনাহ্ হলে দুজনের হয়! এ তো নতুন ফতোয়া নতুন মুরীদ হয়ে বুঝি এ সব শিখেছ?
সালেহা একটু বিরক্ত হইয়া কহিল, যান, ওসব কথা নিয়ে তামাশা করা ভালো না।
না, তামাশা কচ্ছিনে; কিন্তু আজকাল তোমার নামায আর ওজিফার যে রকম বান ডেকেছে, তাতে হয়তো আমি ভেসেই যাব। এই যে আমি এদ্দিন পরে এসে সন্ধে থেকে বসে আছি…
সালেহা অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়া কহিল, খোদার কাজ করতে আপনি মানা করেন?
আবদুল্লাহ্ কৃত্রিম ভয়ের ভাব দেখাইয়া দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, তওবা তওবা, তা কেন করব? তবে কিনা সংসারের কাজও তো মানুষের আছে…।
কেন আমি নামায পড়ি বলে কি সংসারের কাজ আটকে থাকে?
নামায পড়লে আটকায় না বটে, কিন্তু অত লম্বা ওজিফা জুড়ে বসলে আটকায় বৈকি! বিশেষ করে আমাদের মতো গরিবের ঘরে, যেখানে বাঁদী গোলামের ভিড় নেই।
কথাটা সালেহার ভালো লাগিল না। সে তাহার পিতার বড়ই অনুগত ছিল, এবং শৈশব হইতে এ সকল ব্যাপারে তাহারই অনুকরণ করিয়া আসিতেছে। তাহার উপর আবার সম্প্রতি পীর সাহেবের নিকট মুরীদ হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে ধর্মের অনুষ্ঠানে আপনাকে নিয়োজিত করিয়াছে। তাহার বিশ্বাস জন্মিয়া গিয়াছে যে, এইরূপ কঠোর অনুষ্ঠানই পরকালে বেহেশত লাভের উপায়, ইহাই সর্বপ্রথম কর্তব্য। সংসারের কাজগুলি সব নিতান্তই বাজে কাজ, যেটুকু না করিলেই চলে না সেইটুকু করিলেই যথেষ্ট। সংসার সম্বন্ধে ইহার অধিক কোনো কর্তব্য আসিতে পারে না। তাই আজ তাহার স্বামী খোদার কাজ অপেক্ষা সংসারের কাজের গুরুত্ব অধিক বলিয়া মত প্রকাশ করিতেছেন মনে করিয়া সালেহা বিরক্ত, ক্ষুণ্ণ এবং রুষ্ট হইয়া উঠিল। সে একটু উষ্ণতার সহিত বলিয়া ফেলিল, হোক, তবু খোদার কাজ আগে, পরে আর সব।
আবদুল্লাহ্ দেখিল, এ আলোচনা ক্রমে অপ্রীতিকর হইয়া উঠিতেছে। তখন সে কথাটা চাপা দিবার জন্য কহিল, সে কথা ঠিক। তা যাক্, তুমি কেমন আছ, তাই বল।
আছি ভালোই, আম্মার তবিয়ত ভালো তো?
ভালো আর কোথায়! আব্বার এন্তেকালের পর থেকে তার শরীর ক্রমে ভেঙে পড়েছে।
সালেহা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমি তখন যেতে পারি নি বলে কি তিনি রাগ করেছেন?
আবদুল্লাহ কহিল, না–তিনি তোমার উপর রাগ করবেন কেন? তবে আব্বা মরবার সময় তোমাকে দেখতে পান নি বলে বড় দুঃখ করে গেছেন।
তা কী করব, আমাকে পাঠাবার তখন কোনো সুবিধে হয়ে উঠল না। পরে একটু ভাবিয়া সালেহা আবার কহিল, আপনিও তো এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারতেন।
আমি আব্বাকে ফেলে আসি কী করে? তাকে দেখবার শুনবার তো আর লোক ছিল না।
সালেহা চুপ করিয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আবদুল্লাহ কহিল, আমার বোধহয় আর পড়াশুনা হবে না।
তবে কী করবেন?
ভাবছি একটা চাকরির চেষ্টা দেখব।
একজন তো চাকরি করবেন বলে আবার সঙ্গে চটাচটি করে গেছেন…
সে চাকরি করে নিজের উন্নতি করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া তো আমার শ্বশুরের উচিত হয় নি…
আর বাপের অমতে তাকে চটিয়ে, চাকরি করতে যাওয়া বুঝি মেজ ভাইজানের বড় উচিত হয়েছে?
এমন ভালো কাজেও যদি বাপ চটেন, তা হলে লাচার হয়ে অবাধ্য হতেই হয়…
না, তাতে কি কখনো ভালো হয়? হাজার ভালো কাজ হলেও বাপ যদি নারাজ থাকেন, তাতে বরকত হয় না।
স্ত্রীর সহিত তর্কে এইখানে আবদুল্লাহকে পরাস্ত হইতে হইল। অগত্যা সে কহিল, হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। আবদুল কাদেরের উচিত ছিল বাপকে বুঝিয়ে বলে তাকে রাজি করে যাওয়া…
তাতেও কিছু হত না। আব্ব মেজ ভাইজানকে বলেছিলেন আবার মাদ্রাসায় পড়তে। তিনি বলেন, যারা শরীফজাদা তাদের উচিত দীন ইসলামের উপর পাকা হয়ে থাকা। ইংরেজি পড়া, কি চাকরি করতে যাওয়া ওসব দুনিয়াদারী কাজে ইমান দোরস্ত থাকে না বলে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না।
পছন্দ করেন না, তা তো বুঝলাম। কিন্তু যারা এখন শরীফজাদা আছেন, পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে কোনোরকমে না হয় শরাফতি করে যাচ্ছেন। তারপর দুই এক পুরুষ বাদে সম্পত্তিটুকু যখন তিল তিল করে ভাগ হয়ে যাবে, তখন শরাফতি বজায় রাখবেন কী দিয়ে? তখন যে পেটের ভাতই জুটবে না…