এ বাটীর মহিলাগণ চিঠিপত্রের ধার বড় একটা ধারিতেন না। পড়াশুনার মধ্যে কোরান শরীফ, তাহার উপর বড়জোর উর্দু মেহুল জেন্নত পর্যন্ত; ইহার অধিক বিদ্যা তাহাদিগের পক্ষে নিষিদ্ধ ফল। লেখা–তা সে উর্দুই হোক আর বাঙলাই হোক, আর বাঙলা পড়া, এ সকল তো একেবারেই হারাম। হালিমা যদিও পিত্রালয়ে থাকিতে এই হারামগুলি কিঞ্চিৎ আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিল এবং বিবাহের পর স্বামীর উৎসাহে প্রথম প্রথম উহাদের চর্চাও কিছু কিছু রাখিয়াছিল, কিন্তু অল্পকালমধ্যেই শ্বশুরালয়ের কুশাসনে তাহার এই কু-অভ্যাসগুলি দূরীভূত হইয়া গিয়াছিল। আবদুল্লাহ্ হালিমাকে পত্র লিখিলে, সে অপরাপর অন্দরবাসিনীদের ন্যায় বাটীর কোনো বালককে দিয়া অথবা বাহিরের কোনো গোমস্তার নিকট বাঁদীদের মারফত খবর দেওয়াইয়া জবানী-পত্র লিখাইয়া লইত। এইরূপ জবানীপত্র পাইলে আবদুল্লাহ্ ভগ্নীকে লেখাপড়ার চর্চা ছাড়িয়া দিয়াছে বলিয়া ভর্ৎসনা করিয়া পত্র লিখিত এবং সাক্ষাৎ হইলে হালিমা সময় পায় না ইত্যাদি বলিয়া কাটাইয়া দিত। এতদিন সে আসল কথাটি অনাবশ্যক বোধে ভ্রাতাকে বলে নাই, কিন্তু সম্প্রতি তাহার মন এ বাটীর সকলের উপর তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল বলিয়া সে কথায় কথায় অনেক কিছু বলিয়া ফেলিয়াছে। আবদুল্লাহও আজ বুঝিতে পারিল, হালিমা কেন স্বহস্তে পত্রাদি লেখে না। মনে মনে তাহার রাগটা পড়িল গিয়া আবদুল মালেকের ওপর। তিনি কেন পরের চিঠি খুলিয়া পড়েন–তাহার কি একটুও আক্কেল নাই? ছোট ভাই তাহার স্ত্রীর নিকট পত্র লিখিবে, তাহাও খুলিয়া পড়িবেন? কী আশ্চর্য!
এই কথাটি মনে মনে আলোচনা করিতে করিতে আবদুল্লাহর সন্দেহ হইল, বোধহয় সে কলিকাতা হইতে আসিবার সময় পিতার রোগের সংবাদ দিয়া আবদুল কাদেরকে যে পত্র লিখিয়াছিল, তাহাও আবদুল মালেকের কবলে পড়িয়া মারা গিয়াছে। তাহার এই সন্দেহের কথা সে হালিমাকে খুলিয়া বলিল। হালিমা জিজ্ঞাসা করিল, সেটা কি ইংরেজিতে লেখা ছিল?
আবদুল্লাহ্ কহিল, হ্যাঁ ইংরেজিতে। অনেক দিন আবদুল কাদের আমাকে পত্র লেখে নি; আমিও জানতাম না যে, সে চাকরির সন্ধানে বরিহাটে গেছে। তাই বাড়ির ঠিকানাতেই লিখেছিলাম।
হালিমা একটু ভাবিয়া কহিল, একদিন বড় মিঞার ছেলে জানু ইংরেজি চিঠির মতো কী একটা কাগজ নিয়ে খেলা করছিল। আমি মনে করলাম, এ ইংরেজি লেখা কাগজ ওনার ছাড়া আর কারুর হবে না; কোনো কাজের কাগজ হতে পারে বলে আমি সেটা জানুর হাত থেকে নিয়ে তুলে রেখেছিলাম।
আবদুল্লাহ্ আগ্রহের সহিত কহিল, কোথায় রেখেছিলে আন তো দেখি।
তার খানিকটা নেই, জানু ছিঁড়ে ফেলেছিল। আনছি এখনই– এই বলিয়া হালিমা সেই ছেঁড়া কাগজখানি বাক্স খুলিয়া বাহির করিল।
কাগজের টুকরাটি দেখিয়াই আবদুল্লাহ্ বলিয়া উঠিল, বাঃ, এ তো দেখছি আমারই সেই চিঠি।
হালিমা কহিল, তবে নিশ্চয়ই বড় মিঞা ওটা খুলেছিলেন, তারপর ইংরেজি লেখা দেখে ফেলে দিয়েছিলেন।
একটু আগেই যখন আবদুল্লাহ আবদুল মালেককে সেই চিঠির কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল তখন হঠাৎ তাহার চোখে-মুখে একটু বিচলিত ভাব দেখা গিয়াছিল। সেটুকু আবদুল্লাহর দৃষ্টি না এড়াইলেও তাহার নিগূঢ় কারণটুকু বুঝিতে না পারিয়া তখন সে সেদিকে ততটা মন দেয় নাই। এক্ষণে উহার অর্থ বেশ পরিষ্কার হইয়া গেল, তাই সে বড়ই আফসোস করিয়া কহিতে লাগিল, দেখ তো কী অন্যায়! চিঠিখানা না খুলে যদি উনি ঠিকানা ঘুরিয়ে দিতেন, তবে সে নিশ্চয়ই পেত। ইংরেজি চিঠি দেখেও সেটা খুলে যে তার কী লাভ হল, তা খোদাই জানেন! আবদুল কাদের আমার চিঠির জবাবও দিলে না, একবার এলও না; তাই ভেবে আমি তার ওপর চটেই গিয়েছিলাম। ফাতেহার সময় হয়ে গেছে! সে হয়তো এদ্দিন আব্বার এন্তেকালের কথা শুনেছে; আর আমি তাকে একটা খবর দিলাম না মনে করে সে হয়তো ভারি বেজার হয়ে আছে…
হালিমা কহিল না, না ভাইজান, বেজার হবেন কেন? এই চিঠির টুকরাই তো আপনার সাক্ষী! বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, কার জন্যে এটা ঘটেছে। আপনি তাকে একখানা লিখে দিন না।
আবদুল্লাহ্ কহিল, হ্যাঁ কালই লিখতে হবে।
এমন সময় একজন বাঁদী পানের বাটা লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। হালিমা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, পান কে দিল রে বেলা?
ছোট বুবুজী দিয়েছেন।
তাঁর নামায হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, নামায পড়ে উঠেই পান তয়ের কল্লেন।
হালিমা ভ্রাতাকে কহিল, তবে এখন একবার ও-ঘরে যান। রাতও হয়েছে, দেখি গে ভাতের কদ্দূর হল।
দুয়ারের নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হালিমা জিজ্ঞাসা করিল, এবার কদিন থাকবেন, ভাইজান?
কেন বল দেখি?
যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু।
আমার তো তাই ইচ্ছে আছে; এখন দেখি কর্তারা কী বলেন। যদি তারা দুলা মিঞার হুকুম চেয়ে বসেন, তবেই তো মুশকিল হবে…
না, এবার না গিয়ে কিছুতেই ছাড়ব না, তা বলে রাখচি।
আচ্ছা, আচ্ছা দেখি তো একবার বলে কয়ে।
০৬-১০. স্ত্রীর ঘরে
স্ত্রীর ঘরে গিয়া আবদুল্লাহ্ দেখিল, সালেহা খাটের সম্মুখস্থ চৌকির উপর বসিয়া পান সাজিতেছে। ঘরে একটা বাঁদী ছিল; আবদুল্লাহকে আসিতে দেখিয়া সে বাহির হইয়া গেল।
সালেহা তাড়াতাড়ি চৌকি হইতে নামিয়া স্বামীর নিকটবর্তী হইল এবং কদমবুসি করিবার জন্য দেহ নত করিল। আবদুল্লাহ্ ইহার জন্য প্রস্তুতই ছিল, সে তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর বাহুদ্বয় ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল এবং কহিল, আঃ, ছিঃ তোমার ও-রোগটা এখনো গেল না দেখছি।