আবদুল্লাহ্ সকৌতুকে তাহার স্ত্রীর আচার-নিষ্ঠার বিবরণ শুনিতেছিল। শুনিয়া সে কহিল, বটে নাকি? তা হলে তোমার ভাবী তো দেখছি এই বয়েসেই বেহেশতের সিঁড়ি গাঁথতে লেগে গেছেন…।
হালিমা কহিল, না না, ঠাট্টা নয়; ভাবী আমার বড়ই দীনদার মানুষ। তার পর আবার পীর সাহেবের কাছে সেদিন মুরীদ হয়েছেন…
তা তুমিও সেইসঙ্গে মুরীদ হলে না কেন?
হালিমা হঠাৎ বিষাদ-গম্ভীর হইয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমি যে আব্বার কাছেই আর বছর মুরীদ হয়েছিলাম, ভাইজান!
এই কথায় উভয়ের মনে পিতার স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। উভয়ে কিয়ৎকাল নীরব হইয়া রহিল।
আবদুল্লাহ্ হাত বাড়াইয়া কহিল, খোকাকে দেও তো আর একবার আমার কাছে…
ইতিমধ্যে খোকা মাতার স্কন্ধে মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। হালিমা তাহাকে দুই বাহুর উপর নামাইয়া কহিল, এখন থাক, আবার জেগে উঠে চেঁচাবে। শুইয়ে দিই।
আবদুল্লাহ কহিল, আচ্ছা হালিমা, ও-বেচারার বুকের ওপর একটা আধমনি পাথর চাপিয়ে রেখেছ কেন?
হালিমা পুত্রকে শোয়াইতে শোয়াইতে জিজ্ঞাসা করিল, আধমনি পাথর আবার কোথায়?
ঐ যে মস্ত বড় একটা তাবিজ।
ওঃ! ও একখানা হেমায়েল-শরিফ তাবিজ করে দেওয়া হয়েছে।
আবদুল্লাহ্ চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিল, এ্যাঁ! একেবারে আস্ত কোরান!
হালিমা কহিল, কী করব ভাইজান, সকলে মিলে ওর দু হাতে, গলায় একরাশ তাবিজ বেঁধে দিয়েছিলেন। তার কতক রুপোর, কতক সোনার–সেগুলোর জন্যে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু কাপড়ের মোড়ক করে যেগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোতে তেল-ময়লা জড়িয়ে এমন বিশ্রী গন্ধ হয়ে উঠেছিল যে, উনি একদিন রাগ করে সব খুলে ফেলে দিয়েছিলেন। আম্মা, বুবু, এঁরা সব ভারি রাগারাগি কত্তে লাগলেন। তাইতে উনি বললেন যে, একখানা কোরান-মজিদই তাবিজ করে দিচ্ছি–তার চাইতে বড় আর কিছুই নেই! তাই একটা আসী কোরান দেওয়া হয়েছে।
এমন সময় একটা বাঁদী নাশতার খাঞ্চা লইয়া আসিল, এবং শাশুড়ি প্রভৃতি মুরব্বিগণের দোয়া আবদুল্লাহকে জানাইল। আবদুল্লাহ্ কহিল, এখন নাশতা কেন?
হালিমা কহিল, এখন না তো কখন আবার নাশতা হবে?
একেবারে ভাত খেলেই হত।
ওঃ, এ-বাড়ির ভাতের কথা ভুলে গেছেন ভাইজান? রাত দুপুরের তো এদিকে না, ওদিকে বরং যতটা পারে।
তা বটে! তবে নাশতা একটু করেই নেওয়া যাক। এই বলিয়া আবদুল্লাহ দস্তরখানে গিয়া বসিল। একটা বাঁদী সেলাচী লইয়া হাত ধোয়াইতে আসিল। তাহার পরিধানে একখানি মোটা ছেঁড়া কাপড়, তাহাতে এত ময়লা জমিয়া আছে যে, বোধহয় কাপড়খানি ক্রয় করা অবধি কখনো ক্ষারের মুখ দেখে নাই! উহার দেহটিও এমন অপরিষ্কার যে, তাহার মূল বর্ণ কী ছিল, কাহার সাধ্য তাহা ঠাহর করে!
আবদুল্লাহ্ অত্যন্ত বিরক্তির সহিত কহিল, আচ্ছা হালিমা, তোমরা এই ছুঁড়িগুলোকে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পার না? ওদের দেখলে যে বমি আসে। আর এই ময়লা গা হাত নিয়ে ওরা খাবার জিনিসপত্র নাড়ে-চাড়ে, ছেলে-পিলে কোলে করে, তাদের খাওয়ায় দাওয়ায়, এতে শরীর ভালো থাকবে কেন?
ঘরে জন দুই বাঁদী ছিল; আবদুল্লাহর এই কথায় উহারা ফিক্ ফিক্ করিয়া হাসিতে হাসিতে মুখ ঘুরাইয়া চলিয়া গেল–যেন দুলা মিঞা তাহাদের লইয়া ভারি একটা রসিকতা করিতেছেন।
হালিমা কহিল, কী করব ভাইজান, এ বাড়ির ঐ রকমই কাণ্ডকারখানা। প্রথম প্রথম আমারও বড়ড় ঘেন্না করত, কিন্তু কী করব, এখন সয়ে গেছে! অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু হারামজাদীগুলোর সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠি নি। চিরকেলের অভ্যেস, তাই পরিষ্কার থাকাটা ওদের ধাতেই সয় না।
একখানি পরোটার এক প্রান্ত ভাঙিতে ভাঙিতে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, কাপড় ওদের কখানা করে আছে?
ও, তা বড় বেশি না; কারুর ঐ একখানা, কারুর-বা দেড়খানা—
দেড়খানা কেমন?
একখানা গামছা কারুর কারুর আছে, কালেভদ্দরে সেইখানা পরে তালাবে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আসে।
চামচে করিয়া এক টুকরা গোশত ও একটুখানি লোআব তুলিয়া লইয়া আবদুল্লাহ্ কহিল, তা বেচারাদের খানকয়েক করে কাপড় না দিলে কেমন করেই-বা পরিষ্কার রাখে, এতে ওদেরই-বা এমন দোষ কী!
আর খানকয়েক করে কাপড়! আপনিও যেমন বলেন! ও শুয়োরের পালগুলোকে অত কাপড় দিতে গেলে এঁরা যে ফতুর হয়ে যাবেন দুদিনে!
তবু এতগুলো বাঁদী রাখতেই হবে!
হালিমা কহিল, তা না হলে আর বড়মানুষি হল কিসে ভাইজান!–ও কী? হাত তুলে বসলেন যে? কই, কিছুই তো খেলেন না!…
নাশতা আর কত খাব?
না, না, সে হবে না; নিদেন এই কয়খানা মোরব্বা আর এই হালুয়াটুকু খান। এই বলিয়া হালিমা মিষ্টান্নের তশতরিগুলি ভ্রাতার সম্মুখে বাড়াইয়া দিল। অগত্যা আরো কিছু খাইতে হইল।
নাশতা শেষ করিয়া হাত ধুইতে ধুইতে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, আবদুল কাদেরের কোনো চিঠিপত্র পেয়েছ এর মধ্যে?
হালিমা মাথা নিচু করিয়া আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াইতে জড়াইতে কহিল, আমার কাছে চিঠি লেখা তো উনি অনেকদিন থেকে বন্ধ করেছেন।
আবদুল্লাহ্ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?
হালিমা কহিল, এ বাড়ির কেউ ওসব পছন্দ করেন না। বলেন–জানানাদের পক্ষে লেখাটেখা হারাম। তাতেও বাধত না–উনি ওসব কথা গ্রাহ্য কত্তেন না; কিন্তু চিঠি হাতে পেলেই বড় মিঞা সব খুলে খুলে পড়েন, তাই উনি চিঠিপত্র লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।