নষ্ট ঠিক না; আবার কাজ আব্বা করে গেলেন, কিন্তু আমাদের ধরগে’ তোমার.. একরকম ভাসিয়ে দিলেন। তালুক কটা কিনেছে কে, জান?
না, কে কিনেছে?
আবদুল খালেকের বেনামীতে মামুজান কিনেছেন।
কোন্ মামুজান?
রসুলপুরের মামুজান–তিনি ছাড়া ধরগে’ তোমার আবদুল খালেকের, বেনামীতে আবার কে কিনবে?
আবদুল্লাহর খেয়াল হইল রসুলপুরের মামুজান আবদুল খালেকদেরই আপন মাতুল, আবদুল মালেকদিগের বৈমাত্রেয় মাতুল। কিন্তু সে বুঝিতে পারিল না, নিজের নামে না কিনিয়া ভাগিনেয়ের নামে বেনামী কেন করিলেন। সুতরাং ঐ কথা আবদুল মালেককে জিজ্ঞাসা করিল।
আবদুল মালেক কহিল, কী জানি! হয়তো ধরগে’ তোমার কোনো মতলব টতলব আছে।
তা হবে বলিয়া আবদুল্লাহ্ চুপ করিয়া রহিল। এমন সময় অন্দর হইতে তাহার তলব হইল।
.
০৫.
অন্দরে প্রবেশ করিয়া আবদুল্লাহ্ তাহার শাশুড়িদ্বয় এবং অপরাপর মুরব্বিগণের নিকট সালাম আদাব বলিয়া পাঠাইল। তাহার পর হালিমার কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইতেই হালিমা তাহার শিশুপুত্রটি ক্রোড়ে লইয়া কাঁদিতে কাদিতে আসিয়া ভ্রাতার কদমবুসি করিল। পিতার মৃত্যু-সংবাদ পাওয়া অবধি সে অনেক কাদিয়াছে। তাহার স্বামী বিদেশে; এ বাটীতে তাহাকে প্রবোধ দিবার আর কেহ নাই, সুতরাং সে নির্জনে বসিয়া নীরবে কাদিয়াই মনের ভার কিঞ্চিৎ লঘু করিয়া লইয়াছে। কিন্তু আজ ভ্রাতার আগমনে তাহার রুদ্ধ শোক আবার উথলিয়া উঠিল; সে আবদুল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াইয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
উচ্ছ্বসিত শোকাবেগে আবদুল্লাহরও হৃদয় তখন মথিত হইতেছিল; তাই অন্যমনস্ক হইবার জন্য সে হালিমার ক্রোড় হইতে শিশুটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার মুখচুম্বন করিল এবং ধীরে ধীরে দোল দিতে দিতে কহিল, আর মিছে কেঁদে কী হবে বোন! যা হবার হয়ে গেছে, সবই খোদার মরজি।
এদিকে হালিমার পুত্রটি অপরিচিত ব্যক্তির অযাচিত আদরে বিরক্ত হইয়া খুঁতখুঁত করিতে লাগিল দেখিয়া হালিমা তাহাকে ক্রোড় হইতে ফিরাইয়া লইল এবং অনিরুদ্ধ কণ্ঠে কহিতে লাগিল, মরণকালে আব্বা আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এমন কেসমত নিয়ে এসেছিলাম যে, সে সময়ে তার একটু খেদমত কত্তেও পেলাম না–এ কষ্ট কি আর জীবনে ভুলতে পারব, ভাইজান!
আবদুল্লাহ্ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিল, তা আর কী করবে বোন! তখন তোমার স্বামী, শ্বশুর, কেউ বাড়ি ছিলেন না…
কেন, বড় মিঞা তো ছিলেন?
তিনি বললেন যে, বাড়িতে তিনি তখন একলা, কী করে সব ফেলে যাবেন! আর তা ছাড়া তোমার স্বামীর কি শ্বশুরের বিনা হুকুমে…
হ্যাঁ! গরিবের বেলাতেই যত হুকুমের দরকার। কেন?–সেবার আমার বড় জার মার ব্যারামের সময় তো কেউই বাড়ি ছিলেন না, আর উনি তো তখন কলকেতায় পড়েন। বুবুর এক ভাই হঠাৎ একদিন এসে তাকে নিয়ে চলে গেলেন, আমার শাশুড়ি-টাশুড়ি কেউ তো টু শব্দটি কল্লেন না! তারা বড়লোক কিনা তাই আর কারো হুকুম নেবার দরকার হল না…
হয়তো তারা আগে থেকে হুকুম নিয়ে রেখেছিলেন…
না–তা হবে কেন? ওঁরা যেদিন চলে গেলেন, তার এক দিন বাদেই তো আমার শ্বশুর বাড়ি এলেন। বাড়ি এসে তবে সব কথা শুনে চুপ করে থাকলেন।
আবদুল্লাহ্ দুঃখিত চিত্তে কহিতে লাগিল, তা আর কী হবে বোন! বড়লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা কল্লে এ-রকম অবিচার সইতেই হয়। দেখ, তোমার বেলা না হয় দুলা মিঞার হুকুমের দরকার ছিল, কিন্তু আমি তো তোমার ভাবীকে পাঠাতে লিখেছিলাম, তাও তো পাঠালেন না! আবদুল খালেকের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে পাঠাতে পাত্তেন, কিন্তু ভাই সাহেব বললেন, সে গায়ের মহরুম কাজেই তার সঙ্গে পাঠানো যায় না…
হালিমা বাধা দিয়া কহিল, কিসের গায়ের মহরুম? ও-সব আমার জানা আছে। কেবল না পাঠাবার একটা বাহানা! কেন? মজিলপুরের ফজলু মিঞাকে তো এঁরা সকলেই দেখা দেন, তিনিও তো খালাতো ভাই!
আবদুল্লাহ কহিল, ফজলু হল গিয়ে মায়ের আপন বোনের ছেলে, আর আবদুল খালেক সতাত বোনের ছেলে…
তা হলই-বা সতাত বোনের ছেলে; ইনি যদি গায়ের মরুম হন তবে উনিও হবেন। ওসব কোনো কথা নয়, ভাইজান, আসল কথা, ফজলু মিঞারা বড়লোক আর এ বেচারা গরিব।
আবদুল্লাহ্ গম্ভীর-বিষণভাবে মাথা নাড়িয়া কহিল, তা সত্য! গরিবকে এরা বড়ই হেকারত করেন–তা সে এগানাই হোক, আর বেগানাই হোক।
হালিমা একটু ভাবিয়া আবার কহিল, আচ্ছা, ওঁর সঙ্গে যেন না পাঠালেন; কিন্তু বড় মিঞা তো নিজেও নিয়ে যেতে পাত্তেন…
তিনি বাড়ি ফেলে যেতে পাল্লেন না যে!
ওঃ। ভারি তো তিনি বাড়ি আগলে বসে রয়েছেন কিনা! তিনি তো আজকাল বাইরেই থাকেন, অন্দরের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
কেন, কেন! কী হয়েছে?
কথাবার্তা নিম্ন স্বরেই চলিতেছিল; কিন্তু এক্ষণে হালিমা আরো গলা নামাইয়া কহিল, হবে আর কী? ওই গোলাপী ছুঁড়িটেকে উনি নিকে করেছেন কিনা তাই।
এই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ করিবার জন্য আবদুল্লাহ্ কহিল, যাক্ গে যাক। ওসব কথায় আর কাজ নেই। তোমার ভাবী কোথায়?
তিনি আম্মার ঘরে নামায পড়ছেন।
তখন এশার ওক্ত ভালো করিয়া হয় নাই; সুতরাং আবদুল্লাহ্ ভাবিল, বুঝি এখনো মগরেবের জের চলিতেছে। তাই জিজ্ঞাসা করিল, এত লম্বা নামায যে?
হালিমা কহিল ওঃ! তা বুঝি আপনি জানেন না! এবার আমার শ্বশুরের ব্যারামের সময় পীর সাহেব এসেছিলেন কিনা, তাই তখন ভাবী তার কাছে মুরীদ হয়েছেন। সেই ইস্ত আমার শ্বশুরের মতো সেই মগরেবের সময় জায়নামাজে বসেন, আর এশার নামায শেষ করে তবে ওঠেন।