না, না, এবার আবা বড় শক্ত ব্যারামে পড়েছিলেন। জ্বরটা ধরগে’ তোমার দশ-বার দিন ছিল। বড় কাহিল হয়ে গেছেন। একেবারে ধরগে’ তোমার বাচবারই আশা ছিল না। চাচাজানের ফাতেহার সময় ধরগে’ তোমার সে হাঙ্গামেই আমরা কেউ যেতে পারি নি। ধরগে’ তোমা–
তা ফাতেহার সময় যেন যেতে পারেন নি, কিন্তু আবার ব্যারামের সময় যখন আমি খবর পাঠাই, তখন আমার স্ত্রীকে পর্যন্ত পাঠালেন না, হালিমাকেও না। মরণকালে তিনি ওদের একবার দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনাদের মেহেরবানিতে তার ভাগ্যে আর সেটা ঘটল না।
আবদুল মালেক একটু উষ্ণ হইয়া উঠিয়া কহিল, বাঃ, কেমন করে পাঠাই? আবদুল কাদের তখন বাড়িতে ছিল না, আব্বাও ছিলেন না, কার হুকুমে ধরগে’ তোমার পাঠাই!
আবদুল্লাহ একটু শ্লেষের সহিত কহিল, আঁ, বাপ মরে, এমন সময় তো হুকুম ছাড়া পাঠানো যেতেই পারে না! তা হালিমা আপনাদের বউ তাকে না হয় আটকে রাখলেন, কিন্তু আমার স্ত্রীকে কেন পাঠালেন না। তার বেলায় তো আর কারুর হুকুমের দরকার ছিল না।
কার সঙ্গে পাঠাব? বাড়িতে আর কেউ ছিল না, আমি তো আর ধরগে’ তোমার বাড়ি ফেলে যেতে পারি নে!
কেন, আবদুল খালেকের সঙ্গে পাঠালেই তো হত।
আবদুল মালেক যেন একেবারে আকাশ হইতে পড়িল। বলিল, সে কী! তার সঙ্গে? সে হল ধরগে’ তোমার গায়ের মহরুম…
আবদুল্লাহ্ একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, আবদুল খালেক গায়ের মরুম হয়ে গেল!
বাঃ, হবে না? সে হল ধরগে’ তোমার খালাতো ভাই বৈ তো নয়।
কেন, কেবল কি সে খালাতো ভাই? চাচাতো ভাইও তো বটে–বাপের আপন মামাতো ভাইয়ের ছেলে–আবার ধরতে গেলে একই বংশ…
তা হলই-বা, তবু শরীয়তমতো সে ধরগে’ তোমা….
এমন নিকট জ্ঞাতি যে, তার বেলাতেও আপনারা শরীয়তের পোকা বেছে মহরুম, গায়ের মহরুমের বিচার করতে বসবেন, বিশেষ আমার এমন বিপদের সময়, এতটা আমার বুদ্ধিতে জুয়ায় নি।
তা জুয়াবে কেন? তোমরা ধরগে’ তোমার ইংরেজি পড়েছ, শরা-শরীয়ত তো মান না, সে জন্যে ধরগে’ তোমার…
অত শরীয়তের ধার ধারি নে ভাই সাহেব; এইটুকু বুঝি যে মানুষের সুখ-সুবিধারই জন্য শরা-শরীয়ত জারি হয়েছে; বে-ফায়দা কালে-অকালে কড়াকড়ি করে মানুষকে দুঃখ দেবার জন্যে হয় নি। যাক গে যাক, আপনার সঙ্গে আর সেসব কথা নিয়ে মিছে তর্ক করে কোনো ফল নেই। আযানও পড়ে গেল, চলুন নামায পড়া যাক।
বহির্বাটীর এক কোণে ইহাদের বৃহৎ নূতন পারিবারিক মসজিদ নির্মিত হইতেছিল। উহার গম্বজগুলির কাজ শেষ হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু মেঝে, বারান্দা, কপাট, এসকল বাকি থাকিলেও কিছুদিন হইতে উহাতে রীতিমতো নামায আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। আবদুল কুদ্দুস সাহেবের বাঁদী-পুত্র খোদা নেওয়াজ এই নূতন মসজিদের খাদেম। সে-ই আযান দিতেছিল। আযান শুনিয়া আবদুল মালেক আবদুল্লাহূকে লইয়া তাড়াতাড়ি মসজিদের দিকে চলিলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাহার ছোট ছোট কয়েকটি বৈমাত্রেয় ভাই, দুই-এক জন গোমস্তা এবং চাকরদের মধ্যে কেহ কেহ মসজিদে গিয়া উঠিল। প্রতিবেশীরাও অনেকে মগরেবের সময় এইখানে আসিতে আরম্ভ করিয়াছিল; সুতরাং জামাত মন্দ হইল না। আবদুল মালেক ভিড় ঠেলিয়া পেশনামাজের উপর গিয়া খাড়া হইলেন এবং কৃচ্ছ্বসাধ্য কেরাত ও বহুবিধ শিরশ্চালনার সহিত সুরা ফাতেহার আবৃত্তি আরম্ভ করিলেন।
নামায শেষে আবদুল্লাহ্ বাহিরে আসিয়া মসজিদটি দেখিতে লাগিল। একটু পরেই আবদুল মালেক বাহিরে আসিলে কহিল, এখনো তো মসজিদের ঢের কাজ বাকি আছে, দেখছি।
আবদুল মালেক কহিল, হ্যাঁ, এখনো ধরগে’ তোমার অর্ধেক কাজই বাকি।
উভয়ে বৈঠকখানার দিকে অগ্রসর হইল। আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, কত খরচ পড়ল?
ওঃ, সে ঢের। ধরগে’ তোমার প্রায় হাজার আষ্টেক খরচ হয়ে গেছে।
মসজিদটি নির্মাণ করিতে সৈয়দ সাহেবকে যথেষ্ট বেগ পাইতে হইয়াছে। হাতে নগদ। টাকা কিছুই ছিল না; সুতরাং কয়েকটি তালুক বিক্রয় করা ভিন্ন তিনি টাকা সংগ্রহের কোনো উপায় খুঁজিয়া পান নাই। আবদুল মালেক কিন্তু এই বিক্রয় ব্যাপারে মনে মনে পিতার ওপর চটিয়া গিয়াছিল। সে ভাবিতেছিল, পিতা নিজের আখেরাতের জন্য পুত্রদিগকে তাহাদের হক হইতে বঞ্চিত করিতেছেন। তাই মসজিদের খরচের কথায় সে তাহার মনের বিরক্তিটুকু চাপিয়া রাখিতে পারিল না। সে বলিয়া ফেলিল, খান কয়েক তালুকও ধরগে’ তোমার এই বাবদে উড়ে গেছে।
কী রকম?
বিক্রি হয়ে গেছে।
শেষটা তালুক বেচতে হল! কেন, বন্ধক রেখে টাকা ধার নিলেও তো হত।
না; তাতে ধরগে’ তোমার সুদ লাগে যে!
কিন্তু তালুক বিক্রয় করিয়া মসজিদ নির্মাণের কথায় আবদুল্লাহ্ বড়ই আশ্চর্য বোধ করিল। সে কহিল, নিকটেই যখন আবদুল খালেকদের একটা মসজিদ রয়েছে, তখন এত টাকা নষ্ট করে আর মসজিদ দেওয়ার কী দরকার ছিল, তা তো আমি বুঝি নে!
আবদুল মালেক ছোটখাটো একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, যার আখেরাতের কাজ সেই করে রে ভাই; ও মসজিদ যিনি দিয়ে গেছেন, তাঁর কাজ তিনিই করে গেছেন; তাতে করে ধরগে’ তোমার আর কারুর আকবতের কাজ হবে না।
আবদুল্লাহ্ কহিল, এক মসজিদের আযান যত দূর যায়, তার মধ্যে আর একটা মসজিদ দেওয়া নিতান্তই ফজুল। এতে আকবতের কোনো কাজ হল বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। তার ওপর এমন করে তালুক বেচে মসজিদ দেওয়া, এ যে খামাখা টাকা নষ্ট করা।