আবদুল্লাহ্ একটু শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, কেন, কী নিয়ে ঝগড়া কল্লে?
আবদুল্লাহ্ পায়ের ধুলা-মাটি ভালো করিয়া ধুইয়া ফেলিবার জন্য একজন চাকরকে আর এক বদনা পানির জন্য ইশারা করিল। ছোকরার দলের মধ্যে একজন খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বিরক্ত হইয়া আবদুল মালেক জিজ্ঞাসা করিলেন, হাসছিস কেন রে?
একজন কহিল, ঐ দেখুন, ভাইজান, দুলাভাই নাঙ্গল চষে এয়েছেন, তাই এক হাঁটু ধুলো-কাদা লেগে রয়েছে!
আবদুল মালেক এক ধমক দিয়া কহিলেন, যা–যাঃ! ছেঁড়াগুলো ধরগে’ তোমার ভারি বেতমিজ হয়ে উঠেছে! যা-না তোরা, ওযু করে আয় গে, নামাযের ওক্ত হয়ে গেছে, এখনো ধরগে’ তোমার দাঁত বার করে হাসছে আর ফাজলামি কচ্ছে! যাঃ
ছেলের দল তাড়া খাইয়া চলিয়া গেলে আবদুল মালেক কহিলেন, সত্যি, দুলা মিঞা, এমন করে হেঁটে আসাটা ধরগে’ তোমার ভালো হয় নি। নিদেনপক্ষে একখানা গরুর গাড়ি করে তোমার আসা উচিত ছিল।
আবদুল্লাহ্ কহিল, আমার মতো গরিবের পক্ষে অতটা আমীরি পোষায় না, ভাই সাহেব!
আরে না, না; এ ধরগে’ তোমার আমীরির কথা হচ্ছে না। লোকের মান-অপমান আছে তো। এতে ধরগে’ তোমার লোকে বলবে কী?
লোকে কী বলে না বলে, তা হিসেব করে সকল সময় কি চলা যায়? লোকে কেবল বলতেই জানে, কিন্তু গরিবের মান বাঁচাবার পয়সা যে কোত্থেকে আসবে তা বলে দেয় না!
একখানা গরুর গাড়ি করে আসতে ধরগে’ তোমার কতই-বা খরচ হত?
তা যতই হোক, গরিবের পক্ষে সেটা মস্ত খরচ বৈকি!
তবু, ধরগে’ তোমার খোদা যে ইজ্জতটুকু দিয়াছেন, সেটুকু ধরগে’ তোমার বজায় রাখতে তো হবে!
যে ইজ্জতের সঙ্গে খোদা পয়সা দেন নি, সেটা ইজ্জতই নয় ভাই সাহেব! বরং তার উল্টো। সেটাকে যে হতভাগা জোর করে ইজ্জত বলে চালাতে চায়, তার কেসমতে অনেক দুঃখ লেখা থাকে।
কথাটা আবদুল মালেকের ঠিক বোধগম্য হইল না; সুতরাং কী জবাব দিবেন স্থির করিতে না পারিয়া তর্কটা ঘুরাইয়া দিবার জন্য কহিলেন, তোমরা ভাই দু পাতা ইংরেজি পড়ে কেবল ধরগে’ তোমার তর্ক করতেই শেখ; তোমাদের সঙ্গে তো আর কথায় পারা যাবে না! ধরগে’ তো–
আবদুল্লাহ বাধা দিয়া কহিল, যাকগে, ও সব বাজে তর্কে কাজ নেই। আমি নামাযটা পড়ে নিই। নামায শেষে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, আপনি যে বলছিলেন, আবদুল কাদের বাড়ি থেকে ঝগড়া করে বেরিয়েছে…
আবদুল মালেক কহিলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে গোঁ ধরেছে, চাকরি করবে। আব্বা বলেন, না, আবার মাদ্রাসায় পড়;–তা তিনি ধরগে’ তোমার ভালো কথাই বলেন; দু-তিন বছর ঘরে বসে বসে নষ্ট কল্লে, পড়াশুনা কিচ্ছু কল্লে না–তদ্দিনে সে ধরগে’ তোমার পাস-করা মৌলবী হতে পারত–দীনী এলম হাসেল করত। তা সেদিকে তো তার মন নেই; বলে চাকরি করবে।
তা বেশ তো চাকরি কল্লেই বা তাতে ক্ষেতিটা কী হত?
আবদুল মালেক বিরক্ত হইয়া কহিলেন, হ্যাঁঃ, চাকরি করবে। আমাদের খান্দানে ধরগে’ তোমার কেউ কোনো কালে চাকরি কল্লে না। আর আজ সে যাবে চাকরি কত্তে? তা যদি ধরগে’ তোমার তেমন বড় চাকরি টাকরি হত, না হয় দোষ ছিল না;-উনি যে কটর মটর একটু ইংরেজি শিখেছেন, তাতে ধরগে’ তোমার ছোট চাকরি ছাড়া আর কী জুটবে? তাতে মান থাকবে? তাতে বাপ-দাদার নাম ধরগে’ তোমার–
সে গেছে কোথায়, ভাই সাহেব?
গেছে সদরে, আর যাবে কোথায়? মোল্লার দৌড় ধরগে’ তোমার মসজিদ পর্যন্ত কিনা! বলিয়া আবদুল মালেক একটু হাসিয়া দিলেন।
আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, সেখানে বসে কী কচ্ছে, তার কোনো খবর পেয়েছেন?
করবে আর কী? সেখানে আকবর আলী বলে একজন আমলা আছে তার বাপ ধরগে’ তোমার প্যাদাগিরি কত্ত–তারই ছেলে পড়ায় আর সে চাট্টি খেতে দেয়। সে নাকি বলেছে। ওকে সব্রেজিস্ট্রার করে দেবে!
আবদুল্লাহ কহিল, বেশ তো, যদি সব্রেজিস্ট্রার হতে পারে তো মন্দ কী?
আবদুল মালেক নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত কহিলেন, হ্যাঃ, সব্রেজিস্ট্রার চাকরি ধরগে’ তোমার অনি মুখের কথা আর কি! তাতে আবার প্যাদারপোকে মুরব্বি ধরেছেন, দুনিয়ায় আর লোক পান নি!
এই প্যাদার পো’টি কে, জানিবার জন্য আবদুল্লাহ্ বড়ই উৎসুক হইল, কিন্তু তাহার প্রতি আবদুল মালেকের যেরূপ অবজ্ঞা দেখা গেল তাহাতে তাহার নিকট হইতে সঠিক খবর পাওয়া যাইবে, এরূপ বোধ হইল না। পরে এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিলেই জানা যাইবে মনে করিয়া আবদুল্লাহ্ চুপ করিয়া রহিল।
কিছুক্ষণ পরে আবদুল্লাহ্ কহিল, আমি তাকে বাড়ির ঠিকানায় একখানা পত্র লিখেছিলাম, তার কোনো জবাব পেলাম না। বোধহয় সে চিঠি সে পায় নি।
আবদুল মালেক জিজ্ঞাসা করিলেন, কবে লিখেছিলে?
আব্বার ব্যারামের সময়।
আবদুল মালেক যেন একটু বিচলিত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, তা–তা–তা ধরগে’ তোমার ঠিক বলতে পারিনে।
আবদুল্লাহ্ আবার কিছুক্ষণ ভাবিয়া পরে জিজ্ঞাসা করিল, শ্বশুর সাহেব এখন ভালো আছেন তো?
আবদুল মালেক কহিলেন, নাঃ, ভালো আর কোথায়! তিনি ব্যারামে পড়েছেন এই ধরগে’ তোমার প্রায় মাসাবধি হল–
ব্যারামটা কী? এখন কেমন আছেন?
এই জ্বর আর কি! এখন ধরগে’ তোমার একটু ভালোই আছেন।
আবদুল্লাহ্ কহিল, ও জ্বর তো আপনাদের বাড়িতে লেগেই আছে! দুদিন ভালো থাকেন তো পাঁচ দিন জ্বরে ভোগেন। কাউকে তো বাদ পড়তে দেখিন…